দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
লাঙ্গলের সঙ্গে জোর টক্কর দেবে কেটলি
সরেজমিন ঢাকা-১৮
প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৮ উত্তরা এলাকা আসনে নির্বাচনী প্রচারণা জমে উঠেছে। এই আসনের ভোটে বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির পরেও লড়াই হবে ত্রিমুখী। কারণ ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া জাপার প্রার্থীর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা প্রার্থী হিসেবে আছেন কেটলি ও ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে।
আসনটিতে দশজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে কেটলি, লাঙ্গল ও ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীরা আলোচনায় রয়েছেন। এ তিন জনের মধ্যেই মূল লড়াই হবে। আসনটিতে কেটলি ও লাঙ্গলের প্রার্থীর সঙ্গে হাড্ডাহাড়ি লড়াই হবে বলে ভোটারদের দাবি। প্রার্থীদের অধিকাংশই প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারণা চালাচ্ছেন। আসনটিতে বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন যুক্ত হওয়ায় প্রার্থীরা উন্নয়ন প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে রীতিমতো ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীরা প্রাধান্য দিচ্ছে রাস্তাঘাটকে।
ঢাকা-১৮ আসনের অধীন তুরাগ থানাধীন রানাভোলা, তুরাগ, কামারপাড়া, উত্তরা-১০ নম্বর সেক্টরের কিছু অংশসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। পুরো এলাকায় মাইকের উচ্চ শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে প্রচারণা। স্থানীয় আইপি টিভিতেও চলছে ভোটের প্রচারণা। সেই সঙ্গে চলছে সশরীরে প্রার্থী ও তাদের ঘনিষ্ঠ এবং সহযোগীদের জনসংযোগ। পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। মোটামুটি ২৪ ঘণ্টাই প্রচার প্রচারণা চলছে।
সরেজমিন সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে কেটলি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. খসরু চৌধুরী। তিনি সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইম্পোর্টেন্ট পারসন) খেতাবপ্রাপ্ত একজন প্রতিষ্ঠিত
\হব্যবসায়ী। বিজিএমইএ'র পরিচালক, নিপা গ্রম্নপ ও কেসি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।
তুরাগ থানাধীন কামারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক অডিটর এমএ খালেদ খান যায়যায়দিনকে বলেন, আসনটিতে সার্বিক পর্যালোচনায় খসরু চৌধুরী এগিয়ে রয়েছেন। কারণ তিনি এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন। ব্যবসায়ী হওয়ায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। তার আচার ব্যবহারও তুলনামূলক অনেক ভালো। আসনটিতে বিগত দিনে আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন হাবিব হাসান। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় আসনটিতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে খসরু চৌধুরীর অবস্থান অনেক ভালো।
স্থানীয় ভোটাররা জানান, খসরু চৌধুরী ইতোমধ্যেই আসনটির ভোটারদের নানা প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পুরো এলাকার আধুনিকায়ন। মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করা। রাস্তাঘাট তকতকে ঝকঝকে করা। মশক নিধন ও আসনটির যেসব এলাকায় তিতাস গ্যাস নেই, সেসব এলাকায় গ্যাস লাইন সংযোগ স্থাপনের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করার পাশাপাশি এলাকাটিতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন। খসরু চৌধুরীর প্রকৃত বাড়ি গোপালগঞ্জে বলে জানা গেছে।
ভোটারদের দাবি, সেই দিক থেকেও ভোটাররা নানা হিসাব নিকেষ করেই তাকে ভোট দেবেন। কারণ আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতা লাভ করতে পারে, তাহলে খসরু চৌধুরী নানা হিসাব নিকেষে সরকারের কাছ থেকে বেশি বরাদ্দ নিতে পারবেন। যা আসনটির জনগণে কাজে আসবে। আর খসরু চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে বড় মাপের শিল্পপতি হওয়ার কারণে এমপি হয়ে হরিলুট করার সম্ভাবনা কম। কারণ তিনি এমনিতেই অনেক টাকার মালিক। তিনি টাকার জন্য নয়, সম্মানের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এজন্য তিনি এমপি নির্বাচিত হলে এলাকায় অনেক উন্নয়ন হবে।
আসনটির বাসিন্দাদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা, মসজিদ ও মাদ্রাসায় ব্যাপক উন্নয়ন করার প্রতিশ্রম্নতি ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন সমাবেশে। ভোটারদের দাবি, আসনটির অধীন দক্ষিণখান ও উত্তরখানের অবহেলিত এলাকায় ব্যাপকভাবে উন্নয়নের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। এই থানা দুটিতে অর্ধলাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। ভবিষ্যতে আরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রম্নতিও দিয়েছেন এই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
ভোটারদের দাবি, অতীতে আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেত্রী ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সংসদ সদস্য ছিলেন। তার মৃতু্যর পর উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিব হাসান এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন। যে কারণে আসনটিতে আওয়ামী লীগের ভোটারের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আওয়ামী লীগের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও কেটলি প্রতীকের প্রার্থী খসরু চৌধুরীর অবস্থান ভালো। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ ভোটই পাবেন কেটলি মার্কার প্রার্থী। তাই তার এমপি নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
ভোটাররা বলেন, আসনটিতে ত্রিমুখী লড়াই হবে। মূল লড়াই হবে কেটলি প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী শেরীফা কাদেরের সঙ্গে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন আরেক আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেন। তিনি ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এছাড়া আসনটি থেকে কল্যাণ পার্টির হয়ে হাত ঘড়ি প্রতীকে নির্বাচন করছেন দয়াল কুমার বড়ুয়া। ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ পার্টির হয়ে টেলিভিশন প্রতীকে নির্বাচন করছেন এসএম আবুল কালাম আজাদ। ন্যাশনাল পিপলস্? পার্টি-এনপিপি হয়ে আম প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন জাকির হোসেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন বশির উদ্দিন। সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের হয়ে ছড়ি প্রতীকে নির্বাচন করছেন ফাহ্?মিদা হক সুকন্যা। তৃণমূল বিএনপির হয়ে সোনালী আঁশ প্রতীকে নির্বাচন করছেন মোহাম্মদ মফিজুর রহমান। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোড়া প্রতীকে নির্বাচন করছেন নাজিম উদ্দিন।
সরেজমিন কামারপাড়া, রানা ভোলা, তুরাগসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পুরোএলাকায় নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে। চায়ের দোকানে ভিড়। ভিড়ের মধ্যে আলোচনায় রয়েছে ভোট। তবে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্কও লক্ষ্য করা গেছে।
অনেক ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ভোট দিতে প্রস্তুুত। তবে ভোটের পরিবেশ ভালো থাকতে হবে। নির্বাচনে ভোট দেয়ার পরিবেশ ভালো থাকলে ভোটারের উপস্থিতি আশাতীত হবে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অনেক ভোটার আতঙ্কে ভোট দিতে যাবেন না।
ভোটারদের অনেকেই বলেছেন, তারা এখনো ভোট দিতে যাবেন কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। তবে ভোটের পরিবেশ ভালো হলে ভোট দিতে যাবেন। ভোট কেন্দ্রে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে অধিকাংশ সাধারণ মানুষই বাড়তি ঝামেলা এড়াতে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না বলে জানিয়েছেন।
অনেক ভোটার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা নাশকতার আশঙ্কাও করেছেন। তারা বলছেন, ভোটারদের মন থেকে বাড়তি আতঙ্ক দূর হয়নি। অনেকের মধ্যে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও দ্বিধা দ্বন্দ্বে রয়েছেন। যদিও মঙ্গলবার পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকাটিতে বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ, মারামারি বা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
ভোটারদের অনেকেই বলেছেন, বিএনপি অংশ নিলে নির্বাচনটি উৎসবে পরিণত হতো। নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার পক্ষে যার যার মতো করে যুক্তি দেখিয়েছেন অনেকেই। অনেকেই বলেছেন এক তরফা ভোট হবে। আবার অনেকেই এমন মতামতের বিরোধিতা করেছেন।
ভোটাররা বলছেন, নির্বাচন কমিশন তো প্রয়োজনে তফসিল পেছানোর আভাসও দিয়েছিল। তারপরেও তারা ভোটে গেল না। এটি বিএনপির নিজস্ব রাজনীতি। ভবিষ্যতে নির্বাচন ইসু্যতে বিএনপি কি ধরনের রাজনীতি করবে তা বিষয়েও অনেকেই নানা মত পোষণ করেছেন।
কেউ বলছেন, বিএনপি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার অনেকেই বলেছেন বিএনপি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোটারদের মধ্যে এমন তর্ক-বির্তক চলছেই প্রায় প্রতিটি দোকানপাটেই।
সার্বিকভাবে ভোটারদের দাবি, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে চমৎকার নির্বাচন হতো। নির্বাচন নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন করারও সুযোগ ছিল না। এমনকি দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরও না। বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। বিএনপি অংশ নিলে নির্বাচনে যে সত্যিই একটি উৎসব, তা মানুষ উপভোগ করতে পারতেন। মানুষ সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদের ৩০০টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে ১৯১তম আসন ঢাকা-১৮। আসনটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১, ১৭, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। আসনটির মধ্যে রয়েছে ঢাকার উত্তরা, বিমানবন্দর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত এলাকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড ১ ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সঙ্গে রয়েছে তুরাগ থানাধীন হরিরামপুর ইউনিয়ন। এছাড়াও উত্তরখান, দক্ষিণখান ও ডুমনি ইউনিয়নও রয়েছে আসনটিতে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে আদমশুমারিতে জনসংখ্যা বাড়ার চিত্র ওঠে আসে। যে কারণে নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে। আসনটিতে মোট ভোটারের সংখ্যা ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৮ জন। পুরুষ ভোটার ৩ লাখ ১ হাজার ৯০৯ জন। নারী ভোটার ২ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৩ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার মাত্র ৬ জন।