ভোটের মাঠে দুই চিত্র

বিএনপি চায় ভোটাররা যেন কেন্দ্রে না যায়

ভোটের দিনে নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররাও যাতে কেন্দ্রে না যায়, সে বিষয়ে জনমত তৈরিকে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হচ্ছে

প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। প্রতিহত করতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ভোটের মাঠে উত্তাপও ছড়িয়েছিল। ১০ বছর পর এবার দলটি নির্বাচন বর্জন করলেও প্রতিহতের ঘোষণায় যেতে চায় না। তাদের ভাবনায় আছে, উত্তাপ না ছড়িয়েই ভোটারদের উপস্থিতি কমানো। দায়িত্বশীল পর্যায়ের একাধিক সূত্রমতে, বিএনপি এবার নির্বাচন ঠেকানোর চেয়ে ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ৭ জানুয়ারি ভোটের দিনে সরকারবিরোধী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটাররাও যাতে কেন্দ্রে না যায়, সে বিষয়ে জনমত তৈরিকে প্রাধান্য বেশি দেওয়া হচ্ছে। চলমান গণসংযোগে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে দলের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এজন্য গণসংযোগের কর্মসূচির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যাওয়ার পর চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৪ দিন অবরোধ কর্মসূচি করে বিএনপি। এরপর ভোট ঠেকাতে জনগণকে ভোট বর্জনের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। যদিও অসহযোগ আন্দোলনের কার্যকারিতা নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জনগণকে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করতে সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে ১১ দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করে বিএনপি। বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, তারা আসলে বাধ্য হয়েছেন কঠোর কর্মসূচি থেকে সরে আসতে। কারণ মাঠ পর্যায়ের কর্মসূচি বাস্তবায়নকারীরা আর তেমনভাবে সাড়া দিচ্ছে না। এর যৌক্তিক কারণও আছে। তা হচ্ছে, গত দুই মাসের কর্মসূচিতে বেশিরভাগ নেতাকর্মী ঘরছাড়া, হয়রানিতে আছে তাদের পরিবার। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ কম। তাই কর্মসূচি দলেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে তৃণমূল নেতারা কেন্দ্রে জানিয়েছে। এরপরও জোর করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করলেও নির্বাচন ঠেকানো না সম্ভব হবে না বলে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী মনে করেন। এজন্যই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটারদের কেন্দ্র থেকে নিরুৎসাহিত করার আহ্বানের কর্মসূচিই বেছে নিয়েছে বিএনপি। তবে দলীয় ভাবমূর্তির স্বার্থে নির্বাচনের আগের দিন থেকে কয়েকদিন কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ভাবনা এখনো আছে। বিএনপি সূত্রমতে, প্রতিদিনই দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন দলের শীর্ষ নেতা। দূর করা হচ্ছে বিভিন্ন সমন্বয়হীনতা। বণ্টন করে দেওয়া হচ্ছে দায়িত্ব। আলোচনা হচ্ছে কর্মসূচি নিয়ে। সমমনা রাজনৈতিক দল, নেতাকর্মীদের চাহিদা ও সামর্থ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নেতাদের অনেকেই নির্বাচনের আগের দিন শনিবার ও নির্বাচনের দিন রোববার হরতাল-অবরোধসহ 'সব ধরনের কঠোর কর্মসূচি' দেওয়ার পক্ষে। তারা মনে করেন, অস্তিত্বের স্বার্থে রাজপথে 'শক্ত প্রতিরোধ' গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সূত্র জানায়, বিএনপির অধিকাংশ নেতা মনে করেন, কাকতালীয় কিছু না ঘটলে শুধু আন্দোলন করে নির্বাচন আর ঠেকানো সম্ভব নয়। এজন্য ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে বিপদ বাড়ানোর পক্ষে নন তারা। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির কঠোর প্রয়োগ ও নতুন নিষেধাজ্ঞা দিলে পরে কঠোর কর্মসূচির পক্ষে তারা। এজন্য গণসংযোগের পাশাপাশি সমানতালে চলছে কূটনৈতিক তৎপরতাও। 'একতরফা' নির্বাচনসহ বিরোধী দলের ওপর সর্বোচ্চ নির্যাতন, 'ফরমায়েশি' রায় ছাড়াও চলমান পরিস্থিতি উলেস্নখ করে ঢাকার বিদেশি দূতাবাস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অবহিত করেছে দলটি। এর মধ্যে একটি চিঠি গত রোববার জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে থাকবেন দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, 'আমরা রাজপথে আছি, রাজপথে থাকব। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হবে। আমরা কখনো নাশকতায় জড়াইনি, অন্য কোনো পক্ষকে নাশকতা করার সুযোগ দিতে চাই না।' লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত সরকার পতনে চলমান অসহযোগ আন্দোলন এবং 'একতরফা' নির্বাচনে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে লিফলেট বিতরণ ও মিছিল করেছে বিএনপি নেতাকর্মী। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক কেন্দ্রীয় নেতার উপস্থিতিতে বড় শোডাউনে এ কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি মিছিল করেন তারা। চতুর্থ দফায় গণসংযোগের প্রথম দিন মঙ্গলবার সারা দেশে ভোট বর্জনে জনমত গঠনে লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে টাঙানো হয়েছে 'স্টিকার'। একই কর্মসূচি পালন করেছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের মিছিল ও সমাবেশে পুলিশি বাধার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা জামায়াতে ইসলামী ও আমার বাংলাদেশ পার্টি- এবি পার্টিও একই কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপি :বিকালে গুলশান ১ নম্বর ডিসিসি মার্কেটের সামনে ওলামা দলের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিতে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির ড. আব্দুল মঈন খান। এ সময় তিনি বলেন, 'আমরা এই ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করব না। এটা কোনো নির্বাচন নয় তামাশা। এজন্য এই নির্বাচনকে পরিহার করছি। এই সরকার ভিন্ন মত সহ্য করতে পারে না। এজন্যই তারা বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।' সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক। তিনি বলেন, 'পৃথিবীর ইতিহাসে স্বৈরাচার সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নানা কূটকৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কিন্তু কোনো স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। এই সরকারও পারবে না। দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। যে কোনো সময় জনবিস্ফোরণ ঘটবে। গুলশান ২ নম্বরের আশপাশের এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। উপস্থিত ছিলেন মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, মহিলা দলের নেত্রী জাকিয়া আক্তার, পান্না ইয়াসমিন, আয়েশা আক্তার মিলি, হাসিনা আক্তারসহ নেতাকর্মী। এ সময় রিজভী বলেন, এটি কোনো নির্বাচন নয়, এটি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। তারা মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, বাকস্বাধীনতা হরণ করেছে। তারা আবারও মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার আরেকটি সাজানো প্রহসন বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। কিন্তু এবার আর প্রতারণার নির্বাচন করে পার পাওয়া যাবে না।' রাঙামাটি জেলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, দীপেন দেওয়ানের নেতৃত্বে লিফলেট বিতরণ করেন নেতাকর্মী। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুলস্নাহর নেতৃত্বে বরিশালে বড় শোডাউন করে লিফলেট বিতরণ ও মিছিল করেন নেতাকর্মী। বরিশাল জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম জনির নেতৃত্বে বরিশাল নগরীর মুন্সি গ্যারেজ এলাকায় মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন বর্জন, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে জাতীয়তাবাদী যুবদল। সকালে মগবাজার এলাকায় অনুষ্ঠিত ওই কর্মসূচিতে ছিলেন যুবদল কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক বিলস্নাল হোসেন তারেক, সহ-সাধারণ সম্পাদক শাহ্‌? নাসিরউদ্দিন রুমন, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মেহবুব মাসুম শান্ত, সহ-কোষাধ্যক্ষ রোকনুজ্জামান রোকন প্রমুখ। অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিক্ষোভ-মিছিল করেছে ঢাকা জেলা যুবদলের নেতাকর্মী। নেতৃত্ব দেন ঢাকা জেলা যুবদলের সভাপতি ইয়াছিন ফেরদৌস মুরাদ। সকালে সায়েন্সল্যাব মোড় ও সেন্ট্রাল রোড এলাকায় লিফলেট বিতরণ করে ছাত্রনেতা আক্তারুজ্জামান আক্তার, রিয়াদ রহমান, সানজিদা ইয়াসমিন তুলি প্রমুখ। ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নিজাম উদ্দিন রিপনের নেতৃত্বে ফকিরাপুল কাঁচাবাজারে লিফলেট বিতরণ করেছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মী। মুগদা থানা বিএনপির উদ্যোগে নেতাকর্মী লিফলেট বিতরণ করেন। বিভিন্ন স্থাপনায় স্টিকার :নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে রাজধানীর পলস্নবী ও রূপনগর থানা এলাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি, দেওয়াল এবং স্থাপনায় স্টিকার লাগিয়েছে দলের নেতাকর্মী। ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকের অনুসারীরা জনসাধারণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন। সমমনা জোট ও দল : দুপুরে বিজয়নগরে গণসংযোগ করেছে ১২-দলীয় জোট। এ সময় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, এই নির্বাচন ভাগাভাগির নির্বাচন। কারণ এই ডামি নির্বাচনে কারা এমপি হবে তা ঠিক করা হয়ে গেছে। তাই এই নির্বাচনে জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। গণসংযোগে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) নওয়াব আলী খান আব্বাস, জাগপার সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশের মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম প্রমুখ। সকালে তোপখানা রোড ও সেগুনবাগিচায় ভোট বর্জনের পক্ষে লিফলেট বিতরণ করেছে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের নেতাকর্মী। বিজয়নগরে লিফলেট বিতরণকালে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। রাজধানীতে গণসংযোগ করেছে নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপি, গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি, রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন গণধিকার পরিষদসহ অন্যান্য সমমনা দল। জামায়াতের লিফলেট বিতরণ :নির্বাচন বর্জন, ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান এবং দেশের হারানো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সকালে রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজারে লিফলেট বিতরণ হয়। এ সময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তরের কর্মপরিষদ সদস্য ও প্রচার-মিডিয়া সম্পাদক মু. আতাউর রহমান সরকার ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট বর্জনকে গণআন্দোলনে রূপ দেওয়ার আহ্বান জানান। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগরী উত্তরের মজলিসে শূরা সদস্য এম আমিনুল ইসলাম, থানা কর্মপরিষদ সদস্য আবু জাওয়াদ, ছাত্রনেতা তাফহীম ও ইসমাইল হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া তেজগাঁও দক্ষিণ থানার উদ্যোগে মহানগরী মজলিসে শূরা সদস্য নো'মান আহমেদীর নেতৃত্বে কারওয়ান বাজারে লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মসূচিতে ছিলেন থানা কর্মপরিষদ সদস্য ফরিদ আহমেদ, মিয়া মুহাম্মদ তৌফিক, আকবর হোসেন প্রমুখ। রাজধানীর নয়াটোলা এলাকায় লিফলেট বিতরণে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগরী উত্তরের মজলিসে শূরা সদস্য এম কে এইচ আমিন।