ভোটের মাঠে দুই চিত্র

আ'লীগের টার্গেট কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি

নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নূ্যনতম ৩০-৪০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে আনার কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে

প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ভোটের দৌড়ে প্রতিপক্ষকে পেছনে ফেলে জয় নিশ্চিত করাই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মূল টার্গেট থাকলেও এবারের নির্বাচনে সে হিসাব পাল্টে গেছে। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ সংসদীয় আসনে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থীর জয় ভোটের আগেই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে আছে। তবে এরপরও এসব প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রদের এবার ভিন্নধর্মী এক লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নূ্যনতম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে আনার কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস, বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ এবং বিপুলসংখ্যক সংসদ সদস্যের অর্থ-সম্পদ রাতারাতি কয়েকশ' গুণে বৃদ্ধিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এসব জনপ্রতিনিধির ওপর সাধারণ ভোটারের আস্থায় চিড় ধরেছে। এ ছাড়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোটের লড়াইয়ে অংশ না নেওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এক তরফা নির্বাচনে অনেকেই আগ্রহ হারিয়েছে। পাশাপাশি বিএনপির ভোটবর্জনের নানামুখী তৎপরতা সাধারণ ভোটারদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রমুখী করে তোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তরুণদের ভোটে আকৃষ্ট করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদিও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সামলে নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নানামুখী কৌশলী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও গোষ্ঠীর বড় ভোটব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যতিক্রম নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া কেউ যাতে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা গুজব ছড়িয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে না পারে, সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এজন্য দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজে লাগানো যায় তারও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে ভোটের মাঠের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভোটের দিন যতই এগিয়ে আসছে- ভোটের পরিস্থিতি ততই পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব আসনে নৌকার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের এক বা একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে, ওইসব এলাকার ভোটারদের মধ্যে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে তীব্র দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীপূর্ণ প্রতিটি আসনেই প্রায় প্রতিদিনই সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা প্রচারণা ক্যাম্প ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়ে পেশিশক্তির প্রদর্শন চলছে। যা সময়ের সঙ্গে পালস্না দিয়ে আরও বাড়ছে। এতে তরুণ ভোটারসহ সবার মধ্যেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ফলে ভোট দিতে গিয়ে পাছে ক্ষতিগ্রস্ত হন- এ আশঙ্কা ভোটারদের মনে জেঁকে বসেছে। এদিকে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো কোনো কঠোর কর্মসূচিতে না নামলেও ভোট বর্জনে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে লিফলেট বিলিসহ নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন পস্ন্যাটফর্মে এক তরফা ভোটের নেতিবাচক দিক এবং সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কমাতে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যা আওয়ামী লীগের জন্য 'গোদের উপর বিষফোঁড়া' হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী করতে আওয়ামী লীগ নানামুখী তৎপরতা চালালেও বিএনপির ভোটবর্জনের ডাকে তাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিপুলসংখ্যক সাধারণ ভোটারের মধ্যে ভোট দিতে যাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর ওপর ভোটের মাঠে যেভাবে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তাতে জনমনে ভীতিরও সঞ্চার হয়েছে। তাই ভোটারদের ভোটদানে আগ্রহ করে তুলতে প্রার্থীদের যথেষ্ট কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, জনসমর্থনের বিচারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছাকাছি কোনো প্রতিপক্ষ এখনো গড়ে ওঠেনি। যখন একটি পক্ষ নির্বাচনের মাঠে না থাকে, তখন ভোটে দুই পক্ষের ভোটাররাই কোনো আগ্রহ পান না। বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি বলেন, এক গ্রম্নপ ভয় দেখাচ্ছে কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য, আরেক গ্রম্নপ না যাওয়ার জন্য। এটা ভোটারদের জন্য উভয় সংকট। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই এ সংকটকে খুব বড় কিছু মনে করছেন না। তারা মনে করেন, নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে নৌকা ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশিসংখ্যক ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য দৌড়ঝাঁপ করলেও তা অনেকটাই লোক দেখানো। তারা মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে পরাজিত করতেই নিজের পক্ষে ভোট টানার চেষ্টা করছেন। কেননা বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচনে জয় পেতে নূ্যনতম ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ ভোট প্রদানের হার এক শতাংশ হলেও সে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সে কারণে বেশিরভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে না গেলেও তাতে ভোটের রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। বিশ্লেষকরা এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তা নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হলেও ওই প্রার্থীদের সংসদ সদস্য হিসেবে ৫ বছর দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যা হয়নি। সুতরাং এবার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভোট কাস্ট হলেও চলমান রাজনীতিতে নির্বাচিত প্রার্থীকে তেমন কোনো সংকটের মোকাবিলা করতে হবে না। তবে এরপরও ভোটার সংকটের আশঙ্কায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার চরম অস্বস্তিতে আছে বলে মনে করেন তারা। এদিকে ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনার দায়িত্ব প্রার্থীদের। এটা ইসির কাজ নয়- নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মুখে এমন দাবি করলেও ভোটার উপস্থিতির হার নগণ্য হলে তাদের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে নির্বাচন ঠিকমতো না হলে যুক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশনও। সোমবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য না হলে বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, 'আমরা শুধু আমাদের দৃষ্টিতেই এই অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করলে হবে না। আমাদের দিকে সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে আছে। আমরা যদি আমাদের এই নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য করতে না পারি; তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের সব বিষয়; বিশেষ করে আর্থিক, সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু থমকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।' নির্বাচনকে যে কোনো মূল্যে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করার তাগিদ দেন তিনি। এদিকে ভোটের দিন ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়টিতে ইসি যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। ইসি সূত্র জানায়, কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়িয়ে নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করতে চায় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না আসায় ভোটারদের আগ্রহে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভাটা পড়েছে। পাশাপাশি বিরোধী দলের বর্জনে ভোটের পরিবেশ সহিংস হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এসব আশঙ্কা থেকে জনগণকে মুক্ত করে তাদের ভোট কেন্দ্রমুখী করাটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ ব্যাপারে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে চায় সংস্থাটি। তারা মনে করছে, রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত ও নির্বাচনকে সহিংসতামুক্ত রাখা গেলে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে। সেই লক্ষ্য অর্জনে মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে তা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।