নতুন বইয়ের মলাটে-পাতায় নতুনের ঘ্রাণ। নতুন পাঠ্যবই হাতে নিয়ে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে আনন্দে নাচছিল আনসারা তাবাসসুম আরা। রঙিন ফিতা দিয়ে বাঁধা বই দেখিয়ে পেস্ন-গ্রম্নপের এই শিশু শিক্ষার্থী জানাল, নতুন বই পেয়ে তার খুব ভালো লাগছে, সেই সঙ্গে বই বিতরণের এই উৎসবও তার পছন্দ হয়েছে। নতুন বই হাতে নিয়ে নতুন ক্লাসে ওঠার আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে তাবাসসুমের মতো কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।
ইংরেজি বছরের প্রথম দিন সোমবার ঢাকার বিভিন্ন স্কুল থেকে শত শত শিক্ষার্থী জড়ো হয় মিরপুরের ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে 'বই উৎসবে' অংশ নিতে। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন ক্লাসের নতুন পাঠ্যবই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই আসে তাদের অভিভাবকদের হাত ধরে।
সোমবার সকালে মিরপুরের ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে 'বই বিতরণ উৎসব ২০২৪' এর উদ্বোধন করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই স্কুলে 'বই উৎসব' অনুষ্ঠিত হয়।
একই দিনে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শিক্ষার্থীদের হাতে। নতুন বই হাতে নিয়ে নতুন ক্লাসে ওঠার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে সোনামণিরা। অনুষ্ঠানে বই বিতরণ ছাড়া গান, নাচসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উৎসবের মাত্রাকে করে রঙিন। শিশুরা নতুন বই পেয়ে হাত উঁচিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত
ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। সভাপতিত্ব করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত।
আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই নতুন বছরের প্রথম দিন উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সারবে সরকার। ৭ জানুয়ারির ভোটের কারণে বই উৎসবের তারিখে কোনো পরিবর্তন আসবে না। রোববার এই উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
'বই বিতরণ উৎসব ২০২৪' উদ্বোধন শেষে ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, 'বইয়ের পৃষ্ঠা শিশুর মনোজগতে বিস্ময় তৈরি করে। শিশুমনের এ আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে বই বিতরণের সূচনা। সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন বই উৎসবে পরিণত হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষক। সরকার শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে এবং তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলছে। শিক্ষকদের ঘাটতি পূরণে আরও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।'
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ২ কোটি ১২ লাখ ৫২ হাজার ৬ জন শিক্ষার্থীর হাতে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৬০৬টি বই তুলে দিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৯ জন, প্রাথমিকের ১ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার ৫৯৪ জন এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৮৪ হাজার ৪৭৩ জন শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পাবে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য নিজস্ব বর্ণমালা সম্বলিত মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির পঠন-পাঠন সামগ্রী এবং প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই প্রণয়ন এবং সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও উৎসবে জানান প্রতিমন্ত্রী।
এ বছর পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরী) শিশুদের মাঝে প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ জেলায় পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। জেলাগুলো হলো- বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, শেরপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাংগাইল, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, চাঁদপুর, ফেনী, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ।
বই উৎসব অনুষ্ঠানে সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, 'চতুর্থ শিল্প বিপস্নবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার পুরনো ধারার শিক্ষার খোলনলচে পাল্টে এমন এক নতুন শিক্ষার বীজ বপনের কাজে হাত দিয়েছে, যা শিক্ষার্থীর মস্তিষ্ক ও পিঠ থেকে মুখস্থবিদ্যার বোঝা ঝেড়ে ফলে তাদের কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান, গবেষণা ও ভাবনার শক্তিকে জাগাবে ও নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরিতে উপযোগী করে তুলবে।'
বরাবরের মতো বছরের প্রথম দিন বই উৎসব করলেও ছাপার কাজ শেষ না হওয়ায় মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সব বই পেতে অপেক্ষা করতে হবে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। প্রাথমিক ও ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রথম দিনেই সব বই হাতে পাচ্ছে। তবে আংশিক বই নিয়ে ফিরতে হচ্ছে অষ্টম-নবমের শিক্ষার্থীদের।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণির শতভাগ বই উপজেলায় পৌঁছে দিয়েছেন তারা। উপজেলা শিক্ষা অফিস সমন্বয় করে বইগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক বিলি করছে। তবে অষ্টম-নবমের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বই এখনো ছাপা হয়নি। সেগুলো চলতি মাসেই ছাপা শেষে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে।
বই উৎসবের সূচনা হয় ১৩ বছর আগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরের প্রথম দিন থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার প্রচলন শুরু করেন ২০১০ সালে, যা নাম পেয়েছে 'বই উৎসব'।
ক্ষমতাসীন সরকার ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম অনুসরণে সব ক্যাটাগরির বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মাঝে নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। এ পর্যন্ত সারা দেশে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে ৪৬৪ কোটি ৭৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৩ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে সরকার। ২০১৭ সাল থেকে সরকার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় অধ্যায়নের জন্য চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং সাদরি ভাষার বই বিতরণের পাশাপাশি অন্ধ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বই বিতরণ করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তককে আকর্ষণীয় করার জন্য ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত হোয়াইট পেপার, কভার পৃষ্ঠা, হিট থার্মাল পারফেক্ট বাইন্ডিংসহ চার রঙে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হচ্ছে বলে উৎসবে জানানো হয়।
২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরিমার্জিত কারিকুলাম অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হচ্ছে। বই উৎসবে দেশের স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা ছাড়াও অভিভাবক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নতুন বই প্রধানমন্ত্রীর নতুন বছরের উপহার :সিলেটের ডিসি
সিলেট অফিস জানায়, 'বই উৎসব ২০২৪' উদ্বোধনকালে সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, 'নতুন বই শিশুদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নতুন বছরের উপহার। নতুন বই শিশুকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে। সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন বই উৎসবে পরিণত হয়েছে।'
সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক চাঁদ সুলতানার সভাপতিত্বে ও সিনিয়র শিক্ষক কোহেলী রায়ের পরিচালনায় বই উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হোসাইন মো. আল জুনায়েদ ও বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগম। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক (প্রভাতী) মোকাররমা পারভীন, সহকারী প্রধান শিক্ষক (দিবা) আভা রানী দেব, ডিডি অফিসের প্রোগ্রামার মো. সাইফুল ইসলাম।
সিলেট জেলা শিক্ষা অফিস ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, জেলার ৯ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ জন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ি ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭৫ লাখ ৩২ হাজার ৯৮৫টি বই বিতরণ করা হবে। জেলায় প্রাথমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৬০১ জন। এর মধ্যে বইয়ের চাহিদা ছিল ২৩ লাখ ৪১ হাজার ১৬৫টি। এরই মধ্যে শতভাগ বই চলে এসেছে। এগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
নতুন বই হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস
রাজশাহী অফিস জানায়, নগরীর শহীদ মামুন মাহমুদ পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজে বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার বিপস্নব বিজয় তালুকদার।
নতুন বই হাতে পেয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সিরাজুম মুনিরা নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, বই পেলাম, ডায়েরি পেলাম। অনেক ভালো লাগছে। পড়ালেখা করব।
অভিভাবকরা জানান, নতুন বই পেয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হবে তাদের সন্তানরা। সুশিক্ষা নিয়ে দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে এ শিক্ষার্থীরা কাজ করবে বলেও প্রত্যাশা করেন তারা।
অনুষ্ঠানে কলেজটির অধ্যক্ষ মো. গোলাম মাওলাসহ আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।