নির্বাচনকে সামনে রেখে নাশকতা ও অগ্নিসন্ত্রাসের জন্য সরকারকে দায়ী করে জাতিসংঘ ও ঢাকাস্থ দূতাবাসগুলোতে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। পাঁচ পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে ৩০টি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। রোবাবার ই-মেইলের মাধ্যমে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। চিঠিতে স্বাক্ষর করেন রিজভী। এদিন বিকালে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই চিঠি পড়ে শোনান তিনি। আর দলটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জাতিসংঘের মহাসচিবের দপ্তর চিঠিটি গ্রহণ করেছে। চিঠিতে একতরফা নির্বাচন আয়োজন, নাশকতার সঙ্গে সরকার জড়িত ও বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের তথ্য দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে- প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করতে রাষ্ট্রীয় মদদে চলমান অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা চলছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরা তালিকা করে ধারাবাহিকভাবে, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক বিশেষত অগ্নিসন্ত্রাসের বানোয়াট অভিযোগে তারা ছাত্রদল ও যুবদলের সদস্যদের টার্গেট করছে, মিথ্যা মামলায় ফাঁসাচ্ছে।
পাঠানো চিঠিতে বিএনপি জানিয়েছে, 'বর্তমান সরকারের অধীনে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের পটভূমিতে, আবারও আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে একটি প্রহসনমূলক ও সহিংস কারচুপির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তথাকথিত এই 'ডামি নির্বাচন' সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে নাশকতা চলছে, তাতে শুধু গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই নন, নিপীড়ন-নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছেন খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-কাঠামোতে, বিশেষত বাস-ট্রেনে পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে, জনগণের জানমাল ও নিরাপত্তা-স্বাধীনতা বিনষ্ট করছে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশ।'
সহিংসতার বিষয় উলেস্নখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, 'চলমান অগ্নিসংযোগের প্রতিটি ঘটনায় একটি সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যার একমাত্র সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগ ও তার অধীনস্থ রাষ্ট্রযন্ত্র, আর প্রধান ভুক্তভোগী বিএনপি। ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেতৃত্ব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো তদন্ত, তথ্য বা সূত্র ছাড়াই প্রতিটি ঘটনার পরপর অবলীলায় ও একই সুরে অগ্নিসন্ত্রাসের দায় বিএনপির উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের সুপরিকল্পিত এই ধ্বংসযজ্ঞকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার করে তারা রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়নকে উসকে দিচ্ছেন, যা শেখ হাসিনার প্রতিহিংসামূলক বক্তব্যে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।'
গত ১৯ ডিসেম্বর ট্রেনে ২
মর্মান্তিক ঘটনার উলেস্নখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, 'ঢাকায় চলন্ত ট্রেনের তিনটি বগিতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং চারজন যাত্রী মারা যান। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি চিহ্নিত অংশের যোগসাজশে এই নাশকতা সংঘটিত হয়েছে। অগ্নিকান্ডের দুই দিন আগেই, ১৯ ডিসেম্বরের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিশেষভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা, জরুরি পরিষেবা, ডাক্তার এবং অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এখানে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই নির্দেশনাটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। ডিএমপির এই প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়েছিল, নাশকতার সুস্পষ্ট তথ্য ও পরিকল্পনা তাদের কাছে কীভাবে এলো এবং তারপরও এটি রোধে কেন তারা কোনো ব্যবস্থা নিলেন না, জনমনে এসব প্রশ্ন রয়েছে।'
এ ঘটনা ছাড়াও চিঠিতে দশটি অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার ঘটনা উলেস্নখ করে তাতে সুনির্দিষ্টভাবে ওইসব ঘটনার সঙ্গে সরকারের যোগসাজশ রয়েছে বলে দাবি করে বিএনপি। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ তান্ডবে বেশ কয়েকটি যানবাহন ও বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একটি গাড়ির চালক ও সহকারী স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, পুলিশ তাদের গাড়িতে আগুন দিয়েছে। মালিবাগে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তিরা একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে একজন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। ৩১ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবের কাছে, ৬ নভেম্বর ফেনীতে, ১৪ নভেম্বর নাটোরে, ২১ নভেম্বর ভোলায় এক ছাত্রলীগ নেতার বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে একজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও একজন এবং ২৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী মারা যান। ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য পুলিশ সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করে ফেলে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোতে বিএনপি যতবার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, আওয়ামী লীগও একইদিনে পরিকল্পিত নাশকতার উদ্দেশ্যে কর্মসূচি আহবান করেছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশে সারাদেশ থেকে গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। একটি সত্যিকারের নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের বিব্রতকর পরাজয় অনিবার্য। আর তাই, মহাসমাবেশকে বানচাল ও চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, সেদিন একটি ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ পুলিশের চিহ্নিত অংশ।'
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, 'বানোয়াট অভিযোগ ও গায়েবি মামলাসমূহ সাজানো হচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারে বিএনপির আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের যৌথ এই উদ্যোগ আসলে সরকারের মাস্টার পস্ন্যানেরই অংশ। সরকার প্রথমে মিডিয়া কাভারেজ দিয়ে নাশকতার ঘটনা তৈরি করে। এরপর বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিসমূহের উপর দায় চাপিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার করে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনডিআই ও আইআরআই নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের গুলশানের বাসভবনে এর আগে গত শনিবার কমনওয়েথ এবং তার কয়েকদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে বৈঠক করে দলটি।