২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ১৯৪ জনই ছিল স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী। আর কলেজপড়ুয়া ৭৬ জন এবং ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ৪৪ জন মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীও আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনাবসানের পথ বেছে নিয়েছে।
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুক্রবার এক প্রেস কনফারেন্সে এসব তথ্য প্রকাশ করে সংগঠনটি। ১৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার তথ্য থেকে জরিপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
জরিপে উঠে এসেছে, আত্মহত্যাকারীদের অবস্থান বিবেচনায় সবার শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আত্মহননকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ১৪ দশমিক ০১ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৮.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী রয়েছেন।
এছাড়া আত্মহননকারীদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৯.৬২ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭.৪২ শতাংশ এবং রাজশাহী বিভাগে ১৪.০১ শতাংশ শিক্ষার্থী রয়েছেন। অপরদিকে সিলেট বিভাগে তুলনামূলক কম সংখ্যক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, যা ৪ শতাংশ।
শিক্ষা স্তর বিবেচনায় আত্মহননকারীদের মধ্যে বিদ্যালয়গামী অর্থাৎ প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রী রয়েছেন ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা, যা ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছে ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন শতকরা ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ।
জরিপের ফল থেকে জানা যায়, ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সর্বাধিক লক্ষণীয়, যা ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ। বয়সের সীমারেখায় যারা ২১ থেকে ২৬ বছর বয়সি, তাদের মধ্যে ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন।
জরিপ থেকে আরও জানা যায়, ১৩ বছরের নিচে যাদের বয়স, তারাও এই পথ থেকে পিছপা হয়নি। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ জন আত্মহত্যা করেন। তবে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেন ১৪-১৬ বছর বয়সিরা, যার সংখ্যা ১৬০ জন। এছাড়াও সর্বনিম্ন সাত বছরের একটি শিশুও আত্মহত্যা করেন জরিপে উঠে এসেছে।
আত্মহত্যার ঘটনা অনুসন্ধানে আঁচল ফাউন্ডেশনের তরুণ গবেষকরা আত্মহননের পেছনের বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে জানতে পারেন। এর মধ্যে যে কারণগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেগুলো হলো- অভিমান, প্রেমঘটিত কারণ, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, বাসা থেকে মোটর সাইকেল কিনে না দেওয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষণ্নতা, বন্ধুর মৃতু্য, আর্থিক সমস্যার মতো বিষয়ও।
প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন। অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে চাওয়া পাওয়ার অমিল হওয়ায় ৭.৪২ শতাংশ এবং পারিবারিক কলহের কারণে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মানসিক সমস্যার কারণে এই পথে ধাবিত হন ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তাছাড়া পড়াশোনার চাপে ০ দশমিক ৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ০ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১ দশমিক ৯২ শতাংশ আত্মহননের দিকে যান। ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ চুরির মিথ্যা অপবাদে, ১ দশমিক ৯২ শতাংশ আর্থিক সমস্যায়, ০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বন্ধুর মৃতু্যতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়াও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং স্বামী পছন্দ না হওয়ায় ১ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশের আত্মহননের কারণ জানা যায়নি।
আত্মহননকারী কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার পূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের মানসিক অবসাদ কিংবা বিদায় নেওয়ার কথা জানান দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন আটজন এবং ভিডিও কলে এসে আত্মহত্যা করেন দু'জন। আর সেলফি ক্যামেরা নিজের দিকে তাক করে আত্মহত্যা করেন ০ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রেমিক যুগল। এছাড়া মৃতু্যর আগে চিরকুট বা সুইসাইড নোট লিখে আটজন আত্মহত্যা করেছেন। আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও মোবাইলে ধারণের মাধ্যমে বস্ন্যাকমেইলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন চারজন শিক্ষার্থী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছেন। মোটর সাইকেল, মোবাইল চেয়ে না পাওয়ার কারণে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক বড় ধরনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নিতে হবে। সাত বছরের একজন যার আত্মহত্যা বোঝার মতো বয়সও হয়নি, তার আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোও বিশ্লেষণ করে শিশু অবস্থা থেকেই শিক্ষার্থীদের মনোবল শক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে কম বয়সি স্কুলগামী থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, স্কুলগামী আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৬০ শতাংশেরও বেশি। এই হার এত উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে কোনো কারণগুলো আছে তা খুঁজে বের করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে আত্মহত্যা না করলেও তাদের অন্যান্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, পেশাজীবীদেরও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত এবং কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন। এছাড়াও সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রস্তাবনা-
১. আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন। ২. পাঠ্যপুস্তকে মানসিক শিক্ষাকে এবং মনের যত্নের কৌশলগুলোকে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।
৩. স্কুল-কলেজে অভিভাবক সমাবেশের আলোচিত সূচিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা সম্পর্কিত এজেন্ডা রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রদান। ৪. মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা।
৫. প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রদান। ৬. সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। ৭. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা।
৮. হতাশা, আপত্তিকর ছবি, আত্মহত্যার লাইভ স্ট্রিমিং, জীবননাশের পোস্ট ইত্যাদি চিহ্নিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ টুলস ব্যবহার করা। ৯. আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবার ও পরিচিতদের দায় অনুসন্ধানে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা।
১০. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রম্নত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করা।