করোনাকালে সামাজিক অপরাধ কিছুটা বাড়লেও এ মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তা ধাপে ধাপে কমবে- সমাজবিজ্ঞানীরা এমনটা প্রত্যাশা করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। করোনা সংক্রমণ ও মৃতু্য কমে আসায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি সচল হওয়ার পর দেশে খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক নির্যাতন, প্রতারণা, লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা কয়েক গুণ বেড়েছে। এর সঙ্গে অতি সম্প্রতি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সমাজে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে এ সংকট ক্রমাগত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, বৈশ্বিক এই মহামারিতে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ বাড়তে পারে, সেটা কিছুটা অনুমিত ছিল। সেদিকে নজর রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে। তবে গত কয়েক মাস ধরে দেশে যে হারে খুন, নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং বিকৃত যৌনাচারের ঘটনা বাড়ছে, তাতে তারা উদ্বিগ হয়ে উঠেছে। প্রতারণার মাধ্যমে ই-কমার্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সামাজিক অপরাধ নতুনভাবে আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও অভিভাবকদের এগিয়ে আসা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান, ঐতিহাসিকভাবে মহামারি, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো পরিস্থিতিতে অপরাধের চিত্র বদলায়। বিশেষত, যারা অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও মানসিক অশান্তিতে থাকে, তাদের একটি অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। একটি অংশ অপরাধের শিকার হয়। তবে এবার করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর নানা অপরাধকান্ডে সামাজিক অস্থিরতা যেভাবে বেড়েছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এ পরিস্থিতির জন্য বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি অনেকাংশে দায়ী বলে মন্তব্য করেন তারা।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চাঞ্চল্যকর কোনো খুনের ঘটনা ঘটলে, গুরুত্বপূর্ণ কেউ অপহৃত হলে অথবা অন্য কোনো বড় অপরাধ হলে গণমাধ্যমে সমালোচনা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। সরকারও কিছুটা নড়েচড়ে বসে। পুলিশের কর্মকর্তারা দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু কিছুদিন পর গণমাধ্যমের মনোযোগ অন্যদিকে সরে গেলেই সব হারিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত রিপোর্টও আলোর মুখ দেখে না। ফলে অপরাধীরা আড়াল থেকে ফিরে আসে, অথবা ধরা পড়লেও জামিন পেয়ে যায়। নতুন করে অপরাধ ঘটায়। কিংবা গণমাধ্যমে বেশি আলোচনা হলে বিদেশে পালিয়ে যায়। ফলে অপরাধ চক্রের ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়ে না।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হওয়ার অনেক কারণ আছে। কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তাহীনতা। কাজের নিরাপত্তা, খাদ্যের নিরাপত্তা, সুস্থ সমাজের নিরাপত্তা- এই বিষয়গুলো যে কোনো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে। করোনার সময় বিশ্ব জুড়ে দুইটি বিষয় নিয়ে মানুষ বেশি রকমের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এক. বেঁচে থাকার অধিকার এবং দুই. কাজের অধিকার। এ দু'টি নিয়েই করোনাকালে মানুষের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। যা করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পরও কাটেনি। এখনো কর্মহীন অনেক মানুষ কাজের সংস্থান করতে পারেনি। ফলে তারা দিশাহীন হয়ে পড়েছে। কাজ হারানো মানুষ বুঝতে পারছে না কীভাবে সংসার চালাবে। আর যাদের কাজ আছে, তারা বুঝতে পারছে না আগামীকাল তা থাকবে কিনা। এই পুরো বিষয়টি মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলছে। ফলে মানুষ মানসিকভাবে হিংস্র হয়ে ওঠছে। যা মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তুুলছে। দেশের গত কয়েক মাসের অপরাধ পরিসংখ্যানে সে চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিস্থিতি সামাল দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। কারণ সমস্যাটি এক দিনে তৈরি হয়নি। সমাজের প্রতিটি অংশ নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় অপরাধ বেড়েছে। করোনার কারণে মানুষ দীর্ঘদিন ধরে গন্ডিবদ্ধ জায়গায় আবদ্ধ ছিল। এ অবস্থায় অনেকের মধ্যেই মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যা অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বরং কারও কারও মধ্যে তা ক্রমাগতভাবে আরও বাড়ছে। তাই অপরাধ রোধে আইনি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
এদিকে নানা ধরনের অপরাধ ও সহিংসতার কারণে সমাজে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে এর পেছনে বিষণ্নতাকে বড় নিয়ামক বিষয় বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। তাদের ভাষ্য, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। সহনশীলতার মাত্রা কমে যাচ্ছে, সামাজিক অস্থিরতার কারণে বাড়ছে হতাশা ও বিষণ্ন্নতা। ফলে সমাজে বেড়ে চলেছে অপরাধ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বিষণ্ন্নতায় ভুগছে। আর বাংলাদেশে বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭৪ লাখেরও বেশি। গত ১০ বছরে বিশ্বব্যাপী এ রোগের ব্যাপকতা বেড়েছে ১৮ শতাংশ। শুধু বিষণ্নতার কারণে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, বিষণ্ন্নতা থেকেও মানুষ সহিংস হয়ে উঠতে পারে। একজন মানুষকে সুস্থ রাখতে হলে তার মনটাকেও সুস্থ রাখতে হবে। মনের সমস্যায় অবশ্যই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে।
তিনি মনে করেন, সমাজে কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। বেশিরভাগ সময়ে সে পরিবেশ তার কাছের মানুষরাই তৈরি করে দেয়। কখনো কখনো সমাজে মানুষের আচরণ ও অসহযোগিতার কারণে সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণা বা মনোকষ্টে ভুগলে এসব হতে পারে। এ কারণে করোনাকালে সামাজিক অপরাধ বেড়েছে।
এদিকে সমাজিক বন্ধন ঢিলে হওয়ার কারণে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডক্টর নেহাল করিম বলেন, যেসব কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে, সেসব কিশোরের পারিবারিক বন্ধন এবং পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ নেই। বাবা-মা সন্তানের খোঁজখবর রাখেন না। কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, ঠিকমতো স্কুল-কলেজে যাচ্ছে কিনা এসব খোঁজখবর বাবা-মায়ের রাখা উচিত। অভিভাবকরা সচেতন না হলে রাষ্ট্র, পুলিশ বা অন্য কেউই কোনো কিছু করতে পারবে না- যোগ করেন এই সমাজবিজ্ঞানী।
অন্যদিকে ফেসবুক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গোয়েন্দারা জানান, করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে সংখ্যক সাইবার ক্রাইম সংঘটিত হয়েছে, তা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এ মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পও সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে বলে নিশ্চিত করেন তারা।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা জানান, সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণের আগেই সব কিছু দেশের মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ফলে বেশির ভাগ মানুষই এর দায়িত্ব্বশীল ব্যবহার করতে শিখেনি। ফলে অনেকেই এর যথেচ্ছা ব্যবহার করছে। যার পরিণতিতে অনেক সময় সাম্প্রদায়িক দাঙা-ফ্যাসাদ, এমনকি নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটছে। গত দেড় বছরে যে কয়টি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, এর বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে করা হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে দেশে বিরাজমান সামাজিক অস্থিরতা নিরসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সর্তক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে একটি ষড়যন্ত্রকারী চক্র দেশে যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর অপতৎপরতা চালাচ্ছে তা রুখে দিতে দলের পক্ষ থেকে সাংগঠনিকভাবে কোনো কর্মসূচি দেওয়া যায় কি না তা নিয়েও ভাবছে দলটি।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দেশে বিরাজমান সামাজিক অস্থিরতা, নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ ও সমাজিক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে দল। দেশের সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দলের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে প্রচার বাড়ানো হবে। সমাজ থেকে অস্থিরতা দূর করতে প্রশাসনকে সহায়তা করে যাবে দল।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বর্তমানে চলমান সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে আমাদের সব স্তরের নেতাকর্মীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোথাও এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে নেতাদের সচেষ্ট থাকার জন্য বলা হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে এ ধরনের ঘটনার জন্য আরও সচেতন করতে হবে।
তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, যারা গুজবের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, তাদের দলীয়ভাবে প্রতিরোধ করতে সারা দেশের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।