অনলাইনে পুরনো বই বিক্রির মধ্য দিয়ে ১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু করে বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন। মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে অন্য সবাইকে। প্রতিষ্ঠানটি এখন আর্টিফিশিয়াল টেকনোলজি উদ্ভাবন থেকে শুরু করে কাজ করছে স্পেস টু্যরিজম নিয়ে। শুধু অ্যামাজন নয়, বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামও। তবে আমাদের দেশের বাজারে কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বির্তকিত কর্মকান্ডে সম্ভাবনাময় এ খাত ভুগছে ইমেজ সংকটে। প্রচলিত মূল্যের প্রায় অর্ধেক দামে পণ্য দেওয়ার নামে মাসের পর মাস সময় ক্ষেপণ ও পরে অর্থ নিয়ে দেশ ত্যাগের মতো ঘটনাও ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের মধ্যে ই-কমার্স বলতে কেবল অর্ধেক মূল্যে টিভি-ফ্রিজ জাতীয় পণ্য কেনাবেচার মতো ভুল ধারণা তৈরি করছে। গ্রাহকদের এমন নেতিবাচক ধারণা এ খাতে বিনিয়োগে অনাগ্রহ ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরিকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ ছাড়াও পণ্য ও সেবার মান নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ায় দেশের ক্রমবর্ধমান বিশাল বাজার বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দখলে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। এদিকে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে ই-কমার্স খাতে উদ্যোক্তা ও ক্রেতার সংখ্যা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে ভবিষ্যৎ ডিজিটাল মার্কেট পেস্নসে নিজেদের অবস্থান তৈরির দৌড়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়তে পারে। যার বড় প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনীতিতে। এদিকে আলিবাবা, অ্যামাজন, ই-বে, রেকুটেন, অলমার্টের মতো প্রতিষ্ঠান এ দেশে ব্যবসা করতে আগ্রহী। যদিও বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস ও পার্সেলের মাধ্যমে দেশের অনেকেই পণ্য কেনায় এখন বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ক্রেতারা জানান, এমন অনেক পণ্য আছে যা আমদানি করার মতো চাহিদা দেশের বাজারে নেই। সেক্ষেত্রে সমাধান দিচ্ছে ই-পস্ন্যাটফর্মগুলো। শুধু পণ্যের কেনাবেচা নয়, এসব পস্ন্যাটফর্মে লজেস্টিক ও প্রোডাক্টিভ উভয় সেবাই মিলছে। এ বিষয়ে দেশীয় অনলাইন মার্কেট পেস্নস রকমারি ডট কমের কন্টেন্ট অ্যানালাইসিস্ট শাহ রাতুল বলেন, সেবার মান ও ভোক্তার সন্তুষ্টিকে পুঁজি করে সারাবিশ্বে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হয়েছে। এ কারণেই মূলধারার বাইরে গিয়ে ক্রেতারা ই-পস্ন্যাটফর্মে পণ্য কিনছেন। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা, বাড়ছে কর্মসংস্থানও। তবে দেশে ই-কমার্স খাতে চলমান বিতর্ক স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিদেশের বাজার ধরা তো দূরের কথা, দেশের বাজার হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে দেশের অর্থনীতিতে। এ বিষয়ে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্তারা বলছেন, ৫০ হাজার টাকার পণ্য ১০ হাজার টাকায় কোনোভাবেই বিক্রি করা যায় না। এর ফলে অনেক সাধারণ গ্রাহক মনে করছেন ই-কমার্স মানেই অর্ধেক দামে টিভি কিংবা মোটর বাইক কেনা। অথচ উদ্ভাবন ও সেবা নিশ্চিতের মধ্যদিয়ে একজন উদ্যোক্তা গেস্নাবাল মার্কেটে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারে। তারা বলছেন, এখনই এ খাত নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ইমেজ সংকটে পড়বে। এ ছাড়াও দেশে অনেক তরুণ আছে, যারা চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হতে চায়। এর ফলে তাদের পথও বাধাগ্রস্ত হবে। এদিকে, গত কয়েক বছর ধরে দেশের মূলধারার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য কেনাবেচায় অনলাইন নির্ভরতা বাড়িয়েছে। দেখা গেছে, করোনাকালে শো-রুমের চেয়ে অনলাইনে বিক্রি বেশি ছিল। ফলে দেশের বাজারে এ খাতের চাহিদা বৃদ্ধিতে এরই মধ্যে প্রায় ৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির পশাপাশি স্বল্পপুঁজির মাধ্যমে ই-পস্ন্যাটফর্ম ব্যবহার করে সফল হয়েছেন অনেক ছোট উদ্যোক্তা। জার্মান পরিসংখ্যান পোর্টাল স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের আকার দাঁড়াবে ১৯৫ কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২৩ সাল নাগাদ এ খাতের লেনদেন দাঁড়াবে ২৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ বিষয়ে ইস্টার্ন আইটি অ্যান্ড টেকনোলজি ফার্মের ডিরেক্টর ফাহাদ হাসান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ডিজিটালাইজেশনের যুগে এ খাতে পিছিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বর্তমানে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ করছে। আর অগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের সিংহভাগ মানুষ এই সেবার আওতায় আসবে। ফলে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অল্টারনেটিভ মার্কেটের ক্রেতা-বিক্রেতা হবেন। তিনি আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষে এমনকি ছাত্র অবস্থায়ও অনেকেই নিজেদের বিভিন্ন প্রোজেক্ট, লজেস্টিক সাপোর্ট, আইটি সেবা, কমার্শিয়াল প্রোডাক্ট ডিজাইন থেকে শুরু করে মেশিনারি ডেভেলপমেন্ট সেবা অনলাইনে অফার করছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত ক্রেতা সেসব সেবা নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে তারাও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তা হতে চান। তিনি জানান, তার আইটি সলু্যশন বিভাগে এমন অনেক কর্মী আছেন যারা এবং তাদের বেশ কিছু প্রোজেক্ট আছে যা আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন। তবে এই আইটি উদ্যোক্তা বলেন, দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পণ্য তৈরি খরচের চেয়েও কম দামে দেওয়ার নামে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি বেশিদিন করতে পারবে না। কারণ গ্রাহকরা এখন সচেতন হয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের উচিত এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা। না হলে সম্ভাবনাময় দেশীয় তরুণ উদ্যোক্তাদের পথ আরও কঠিন হবে। তাই এ সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো দপ্তর বা পরিদপ্তর চালু করে তা কঠোর বিধিমালার মধ্যে আনা জরুরি। এদিকে, এ খাতের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে এ বছর জুলাইয়ে নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ- বেশকিছু প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা মানছে না। এ ছাড়াও এ বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ই-কমার্স ব্যবসার সার্বিক বিষয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা বা আইন করার কথা থাকলেও এখনো প্রকাশ করা হয়নি। অন্যদিকে, বিদ্যমান নীতিমালা ভঙ্গ করলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন অবস্থায় ই-কমার্সে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এসব নীতিমালার আলোকে শিগগিরই আইন প্রণয়ন করার কথা জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডবিস্নউটিও সেলের মহাপরিচালক এবং কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, এক্ষেত্রে সরকার আলাদা একটি সেল বা কমিটি গঠন করতে পারে, যারা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনবে। এ ছাড়াও ক্রেতারা সহজেই ডিজিটাল কমার্স সেল বা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। সেজন্য একটি হটলাইন চালু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ই-কমার্সের ভোক্তা, মার্চেন্ট-সব পর্যায়ে পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি করণীয়/বর্জনীয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন আলমাস কবির। এ ছাড়াও বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পদ্ধতিও বাস্তবসম্মত নয়, তবে দ্রম্নত ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।