জলবায়ুর প্রভাব পোড়াচ্ছে এল নিনো ভাসাবে লা নিনা
প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
আলতাব হোসেন
জলবায়ুর প্রভাবে 'এল নিনো' নামে পরিচিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে খরা আর ঘাম ঝরানো গরমে এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। অত্যন্ত শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে, ৪০ ছুঁই ছুঁই করছে। প্রচন্ড তাপদাহে পুড়ছে ফসলের মাঠ। ধানের ক্ষেত, সবজি, আলু, লিচু ও আমের মকুল ঝরে যাচ্ছে। তাপদাহে বাড়ছে রোগব্যাধি। করোনার মধ্যে ঘরে ঘরে ডায়রিয়া, হিটস্ট্রোকসহ বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
'এল নিনো' ও 'লা নিনো' জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খরা, তাপদাহ ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী এল নিনো ও লা নিনা। লা নিনো অথবা লা নিনা স্প্যানিশ শব্দ। স্প্যানিশ ভাষায় নিনো শব্দের অর্থ ছেলে আর নিনা শব্দের অর্থ মেয়ে। এল নিনো শব্দের অর্থ ছোট ছেলে এবং লা নিনা অর্থ ছোট মেয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল পানি ও উষ্ণ পানির তারতম্য বিশ্লেষণ করে পেরুর জেলেরা এল নিনো ও লা নিনোর অস্তিত্ব খুঁজে পান। বিজ্ঞানীরা শুরুতে এ অবস্থাকে স্থানীয় ঘটনা হিসেবে দেখেন। পরে ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী গিলবার্ট দেখান যে এল নিনো বা লা নিনার সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের মধ্যে সম্পর্ক আছে। তখন বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসলেন এবং এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে তার সত্যতা খুঁজে পান।
এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের দ্বাদশ দীর্ঘ মেকং নদীর পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে। মেকং নদীবিধৌত বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামে খরা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মেকং নদীর পানি অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় ভিয়েতনামের ফসলি জমির ৫০ শতাংশ লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। পাঁচ হ
\হলাখের বেশি মানুষ সুপেয় বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াও সংকটের মধ্যে পড়েছে। পরিস্থিতি অবনতি ঘটেছে মালয়েশিয়ায়ও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইএইচএস গেস্নাবাল ইনসাইট জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বছরে হাজার কোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও জানিয়েছে, পর্যাপ্ত মজুত থাকায় খাদ্য সংকট এখনো তীব্র হয়ে ওঠেনি; কিন্তু সামনের দিনগুলোয় বিশ্ব পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে এল নিনো বা লা নিনার প্রভাব রয়েছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের আবহাওয়া এল নিনো এবং লা নিনার প্রতি সংবেদনশীল। পেরু ও চিলির প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ব্যতিক্রমী উষ্ণ ও শীতল সমুদ্র স্রোত পর্যায়ক্রমে এল লিনো ও লা লিনো ভারত সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মৌসুমি বায়ুকে প্রভাবিত করছে। তাই বলা হচ্ছে, এল নিনো ও লা নিনা পরক্ষোভাবে বাংলাদেশের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৭ সালের বন্যায় বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে লা নিনা ছিল ওই বন্যার অন্যতম কারণ। বলা হচ্ছে- ছিয়াত্তরের মনন্তর বা তেতালিস্নশের মনন্তরের কারণ ছিল এল নিনো। বাংলাদেশে যেসব বছরে খরা হয়েছে যেমন- ১৯৭৩-৭৪, ১৯৯৭ ইত্যাদি বছর ছিল এল নিনোর বছর। আবার যে বছরগুলোতে বন্যা হয় যেমন- ১৯৭০, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৬, ২০১৭ ও ২০২০ বছরগুলো ছিল লা নিনার বছর।
সাধারণত এল নিনোর পরপরই লা নিনা আসে। এল নিনোর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে লা নিনা শুরু হয়। এল নিনার প্রভাবে সাগরে উষ্ণ পানির স্রোত প্রবাহিত হওয়ার পর পরবর্তী সময়ে সাগরের পানির উষ্ণতা কমে আসে। সাগরের পানির এ উষ্ণতা কমে আসাকে লা-নিনা নামে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। লা-নিনার প্রভাবে অতিবৃষ্টি ও বন্যা হয়। ১৯৯৮ সালে লা-নিনার প্রভাবে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে ভয়াবহ এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়। বছরের শেষ দিকে লা নিনা দেখা দিলে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিসের কৃষিকর্মীরা জানান, বন্যা ও ভূমিধসের মধ্য দিয়ে এশিয়ার ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারে লা নিনা। প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনেও। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এল নিনো ও লা নিনা দ্রম্নত সক্রিয় হয়ে উঠছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ডক্টর আশুতোষ সরকার বলেন, তীব্র উষ্ণতা নিয়ে আসা এল নিনোর পরই বিপরীত প্রতিক্রিয়া নিয়ে আসবে লা নিনা। লা নিনার প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টি ও হিমবাহ গলে বন্যা দেখা দেবে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা বন্যায় এশিয়াবাসীর সংকট দ্বিগুণ করে তুলবে। এল-নিনোর প্রভাব কমে আসার পর প্রশান্ত মহাসাগরে নতুন রূপে আসবে অতিশীতল পানি। এ সময় জেলেদের জালে মাছ বেশি ধরা পড়ে। তখন আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করে। বায়ু হয়ে যায় শুষ্ক। বৃষ্টির দেখা মেলে না, তীব্র খরা দেখা দেয়। এ অবস্থাকে জেলেরা নাম দিয়েছেন লা-নিনা।
জলবাযু বিশেষজ্ঞ ডক্টর অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম যায়যায়দিনকে জানান, প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ। সুতারাং এ মহাসাগরের পরিবর্তনে পুরো পৃথিবীরই পরিবর্তন ঘটে আর ভূ-পৃষ্ঠ থেকে জলভাগে পরিবর্তনে জলবায়ুর পরিবর্তন বেশি হয়। বিষুবরেখার ওপাশ থেকে নেমে আসা উষ্ণ পানির স্রোতের কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর প্রভাবকে ইকুয়েডর ও পেরুর জেলেরা এল নিনো শব্দের ব্যবহার করে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে ইকুয়েডর ও পেরুর উপকূলের দিকে বিষুবরেখার অন্যদিক থেকে উষ্ণ পানির স্রোত আসতে শুরু করে। ফলে সাগরের পানির উষ্ণতা বাড়ে এবং ঝড়, খরা, অনাবৃষ্টি হয়। সাধারণত দু-এক বছর পরপর এল নিনো দেখা দেয়। এল নিনোর প্রভাবে তুষার ঝড়, দাবানল এবং খরা সংঘটিত হয়।