বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৩ বছর

কিছু সংকট থাকলেও উন্মুক্ত হয়েছে উন্নয়নের দ্বার

ফজলুর রহমান রাজন, রাঙামাটি
  ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:৩০
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র জমা দিচ্ছেন সন্তু লারমা -ফাইল ছবি

আজ ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করে এর স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা শান্তিচুক্তি নামে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলা সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের। অস্ত্র সংবরণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন পাহাড়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র গেরিলারা। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও বিবদমান ৪টি গ্রম্নপের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত কখনো পাহাড়ি বাঙালি দাঙ্গায় প্রতিনিয়ত সবুজ পাহাড় রক্তে লাল হচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য চুক্তি পক্ষ জনসংহতি সমিতি সরকারকে দোষারোপ করলেও সরকারিদল বলছে চুক্তি পক্ষের অসহযোগিতার জন্য চুক্তি বাস্তবায়ন ধীরগতিতে এগুচ্ছে। তবে শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে কাঙ্ক্ষিত শান্তি না এলেও উন্নয়নের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। চুক্তির পর পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ চার ভাগ থাকলে বর্তমানে মূল দলগুলো ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক সময় চারটি সংগঠনের মধ্যে অন্তর্কলহ লেগে থাকলেও এক পর্যায়ে অস্তিত্ব রক্ষায় মূল জেএসএস, ইউপিডিএফ একপস্নাট ফর্মে চলে আসে। এরপর আবার দুই সংস্কার জেএসএস ও ইউপিডিএফ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আলাদা পস্নাটফর্মে মূল জেএসএস ও ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর জেএসএস ভেঙে ইউপিডিএফ হয়, আবার ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস ভেঙে জেএসএস সংস্কার নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলে ও সুধা সিন্ধু খীসা। এসময় চলতে থাকে ত্রিমুখী সংঘাত, ২০১৫ সাল থেকে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আবার ইউপিডিএফ ভেঙে নতুন ইউপিডিএফ সংস্কার নামে আরেকটি সংগঠন হয়। ইউপিডিএফ সংস্কার হওয়ার পর আবারও পাহাড়ে শুরু হয় রক্তের নির্মম হোলিখেলা। ইউপিডিএফ সংস্কার শুরুতে মূল ইউপিডিএফের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যাসহ জেএসএস নেতা কর্মীদের হত্যা শুরু করে। নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস সংস্কারের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে ২০১৮ সালের ৩ মে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে, নিহত অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় যোগ দিতে ৪ মে খাগড়াছড়ি থেকে নানিয়াচর যাওয়ার পথে ইউপিডিএফ সংস্কারের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ৬ জন নিহত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিপূর্বে আঞ্চলিক দলগুলোর রেষারেষি এবং গুলিতে কেউ মারা গেলে মামলা হতো না, তবে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস চাঁদাবাজি ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার আন্দোলন শুরু করলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবার মামলা করা শুরু করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা ও ইউপিডিএফ সংস্কারের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা নিহত হওয়ার ঘটনায় দুটি পৃথক মামলায় ইউপিডিএফের প্রধান প্রসীত খীসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মী, ইউপিডিএফ সমর্থিত জনপ্রতিনিধি এবং মূল জেএসএসের সন্তু লারমা এবং উষাতন তালুকদারকে বাদ দিয়ে বাকি কেন্দ্রীয় ও জেলা এবং উপজেলা নেতাদের আসামি করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর সরকারি কর্মকর্তাদের বড় ধরনের হামলার ঘটনা না ঘটলেও ২০১৯ সালের মার্চে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন শেষে বাঘাইছড়ি সদরে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সহকারী প্রিজাডিং অফিসারসহ ৭ জন নিহত হন। একের পর এক মামলা এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানের মুখে অধিকাংশ নেতাকর্মী পালিয়েছেন, ঘর-বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। এছাড়া জেএসএসের মূল চাঁদা কালেক্টর জ্ঞান শংকর চাকমাসহ বেশ কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিবদমান আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে পাহাড়ে গত ৬ বছরে খুন হয়েছেন অন্তত ৫ শতাধিক। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের অনেক পদধারী নেতাও আঞ্চলিক সংগঠনের হাতে খুন হয়েছেন। এছাড়া চারটি আঞ্চলিক সংগঠন- জনসংহতি সমিতি (জেএএসএস-মূল), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) কাছে ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র থাকারও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- রকেট লঞ্চার ৫৪টি, এসএমজি ৬৪১টি, বিভিন্ন ধরনের রাইফেল ৫৯৪টি এবং হাতবোমা আছে এক হাজারেরও বেশি। এছাড়া চার শতাধিক দেশি পিস্তল ও বন্দুক এবং ৪০টি মর্টার রয়েছে। রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেছেন, সরকার শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে, বাকিগুলো বাস্তবায়নাধীন। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের অসহযোগিতার কারণে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, শান্তি চুক্তির পরও পাহাড়ে এখন চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চলছে, চুক্তির সময় কিছু অস্ত্র জমা দিলেও এখনো অনেক অবৈধ অস্ত্র রয়ে গেছে। এসব অবৈধ অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি এবং আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। যতদিন পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র থাকবে ততদিন পাহাড়ে শান্তি আসবে বলে মনে করি না। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর গত ২৩ বছরে তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তির বর্ষপূর্তিতে এক প্রতিক্রিয়ায় চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেছেন, ২৩ বছর একটা দীর্ঘ সময়, সরকার এবং আঞ্চলিক পরিষদ আন্তরিক হলে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব। চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় আরও বলেন, শান্তি চুক্তির পর অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা, কিছু প্রতিষ্ঠান হওয়া এসব ছাড়া চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। অংকে কষে চুক্তির বাস্তবায়নের হিসাব করা যায় না, জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ কার্যকর এবং এগুলোর নির্বাচন হয়নি। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের একটি পরিবারও পুনর্বাসন হয়নি, এসব পরিবার মানবেতর দিন যাপন করছে। পার্বত্য নাগরিক পরিষদের রাঙামাটি জেলা সভাপতি শাব্বির আহম্মদ বলেছেন, শান্তিচুক্তির ২৩ বছরেও পাহাড়ে শান্তি আসেনি, আগে এক গ্রম্নপ চাঁদাবাজি করত, এখন চার গ্রম্নপকে চাঁদা দিতে হয়। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সন্তু লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল তিনি তার মর্যাদা রাখতে পারেননি। তাই আমরা মনে করি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্প পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে কেবল পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসতে পারে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরও পাহাড়ে অশান্তি থাকলেও উন্নয়নের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পৌরসভা, এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ইউএনডিপির সিএইচটিডিপি প্রকল্প ও সেনাবাহিনী, রাস্তা-ঘাট, স্কুল কলেজ, ব্রিজ, কালভার্ট, মাদ্রাসা মসজিদ, মন্দির, কেয়াং প্রাগোডা নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করেছে। রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। নানিয়াচরের চেঙ্গি নদীর উপর নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড়ের সবচেয়ে বড় দীর্ঘ সেতু। এছাড়া সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সীমান্ত সড়কের (রাস্তা) কাজ চলছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। একটি সরকারি সংস্থার হিসাবমতে পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পাহাড়ে অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করেছে। পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদু্যৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে বর্তমানে ৬শ' কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া শান্তিচুক্তির ফলে সৃষ্টি হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্স, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। এছাড়া শান্তিচুক্তি অনুযায়ী তিনটি জেলা পরিষদে ৩৩টি বিভাগের মধ্যে রাঙামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে। উপজাতি জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এদিকে বুধবার পালিত হবে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৩ বর্ষপূর্তি। করোনাভাইরাসের কারণে এবার বড় ধরনের আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও এ উপলক্ষে প্রশাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন মহলের উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে সকালে শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিকালে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে জেলা আওয়ামী লীগ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে