শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ভাস্কর্য ইসু্য

ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে আ'লীগের

২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর হেফাজত ও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব কমতে থাকে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কওমি সংগঠন ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বেশ সখ্য ছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা
ফয়সাল খান
  ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

দেশের ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর সরকারের বিপক্ষে তেমন কোনো জোরালো কর্মসূচি বা বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন জায়গায় সরকারের প্রশংসা করছেন তাদের অনেকেই। শোকরানা মাহফিল করে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতেও দেখা গেছে; কিন্তু সম্প্রতি ভাস্কর্য ইসু্যতে ইসলামি সংগঠনগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার কারণে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ ইসু্যতে সরকার ও ইসলামি দলগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। ভাস্কর্য অপসারণ ও নতুন করে স্থাপন না করার দাবিতে অনড় থেকে নানা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন ইসলামি দলগুলোর নেতারা। সরকারি দল ও তাদের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ দাবির বিপক্ষে নানা বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি রাজপথে কর্মসূচিও পালন করছে।

এসব কর্মসূচি থেকে ভাস্কর্য বিরোধীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ইসলামি দলগুলোর দাবি প্রত্যাখ্যান করে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জেলা-উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে এ বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কওমিসহ প্রায় সব মতাদর্শে বিশ্বাসী বক্তারাই এসব মাহফিল থেকে ভাস্কর্য স্থাপনা না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। পাশাপাশি মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের দাবি ও সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনাও করছেন ওয়াজ মাহফিলের বেশিরভাগ বক্তা।

কিন্তু ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর এসব কর্মকান্ডে হেফাজত ও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব কমতে থাকে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কওমি সংগঠন ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বেশ সখ্য ছিল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে হঠাৎ ভাস্কর্য বিতর্কে হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের ফের দূরত্ব তৈরি হয়। হেফাজতে ইসলামের আমির আলস্নামা শাহ্‌ আহমদ শফীর মৃতু্য ও এর পরবর্তী দলীয় সম্মেলনের পর সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। সম্প্রতি ভাস্কর্য ও মূর্তি নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও কর্মসূচিতে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হেফাজত ও ইসলামি দলগুলোর নেতাদের বক্তব্যে যাতে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় সে জন্য ভাস্কর্য ও মূর্তির প্রকৃত ব্যাখ্যা তুলে ধরতে নানা

কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের ধারণা, তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে ইসলামি দলগুলোর নেতারা তাদের ভুল বুঝতে পারবেন। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইসু্যতে কোনো ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ।

সূত্রমতে, শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে নানা ইসু্যতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকা কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন, হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কয়েকটি ইসলামি দলের সম্পর্কের বরফ গলতে থাকে। ফলে ২০১৮ সালে কওমি মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিন) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) স্বীকৃতি দেয় সরকার। তখন হেফাজতে ইসলামের আমির প্রয়াত আলস্নাম আহমদ শফী ও কওমি আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। একই বছর ৪ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরানা মাহফিল থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেন কওমি মাদ্রাসার আলেমরা। সারাদেশ থেকে আসা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'কওমি জননী' উপাধি দেওয়া হয়।

এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবির প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসব কর্মসূচি থেকে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমসহ ভাস্কর্য বিরোধীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভাস্কর্য ইসু্যতে মন্ত্রীরা নানা বক্তব্য দিলেও তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না সরকার। সরকারে পক্ষ থেকে ইসলামি দলগুলোকে মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্য অনুধাবন করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশে স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইসু্যতে কোনো ধরনের আপস করবে না আওয়ামী লীগ। খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য দিলেও ভাস্কর্য স্থাপনার ব্যাপারে এখনো আগের বক্তব্যেই অনড় আছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী শিল্পকলার শক্তিশালী মাধ্যমে ভাস্কর্যের বিরোধিতায় নেমেছে। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বক্তব্য বরদাশত করা হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, কিছুদিন ধরে ঢাকার ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ইসু্যতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে দেশের ধর্মীয় অঙ্গন। স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ কিংবা প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ অনৈসলামিক সংস্কৃতি হওয়ায় আলেমসমাজ এর প্রতিবাদ করছে। তিনি বলেন, কোনো ষড়যন্ত্র অথবা গোপন আঁতাতের মাধ্যমে রাষ্ট্র কিংবা সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি তাদের নেই। অতীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জোটবদ্ধভাবে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখলেও বর্তমানে আমাদের সংগঠন খেলাফত মজলিস এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো রাজনৈতিক জোটে যুক্ত নেই। আমরা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী নই। আমরা ভাস্কর্যের বিরোধী।

এদিকে ভাস্কর্য ইসু্যতে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিয়ে ইসলামি দলগুলোর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সরকারি দলের নেতারা। আলাপকালে আওয়ামী লীগের দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম যায়যায়দিনকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতা, আমাদের আদর্শ। তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তার সম্মান ও মর্যাদা আইন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে তারা মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্যই বোঝে না। ভাস্কর্য হলো প্রতিকৃতি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করে কেউ পূজা করবে না। তাকে সম্মান জানাতে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিসত্তার ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ নীতি-আদর্শের প্রশ্নে কখনোই আপস করে না। যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে চায়, যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়, তারাই এমন দাবি তুলছে। এসব দাবি বা বক্তব্য কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে