বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অর্ধশত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

অডিট আপত্তির জবাব দিচ্ছে না অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
নূর মোহাম্মদ
  ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

দেশের ১০ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ১৩টি খাতে ৪৭ কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে মহা-হিসাব নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (সিএজি) নিরীক্ষায়। বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা এসব অডিটের জবাব দফায় দফায় চেয়েও পায়নি সিএজি। দ্রম্নত জবাব না দিলে এসব আর্থিক অনিয়মের ঘটনা সত্য হিসেবে গণ্য করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ভর্তি ফরম বিক্রির টাকার ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে না রাখা, সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস করেও নির্ধারিত হারের চেয়ে কম হারে বাড়ি ভাড়া কর্তন, অনিয়মিত অসম গ্রেডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেতন সমতা করা, শিক্ষকদের মাসিক দায়িত্বভাতা বাড়িয়ে নেওয়া, বিধিবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মোবাইল ভাতা, যাতায়াত  ভাতা, ডিন ভাতা, গবেষণা ভাতা, পরিচালক ভাতা, প্রোভোস্ট ভাতা, চেয়ারম্যান ভাতা ও জ্বালানি ভাতা বরাদ্দ, প্রাপ্য ভাতার চেয়ে বেশি বই ভাতা দেওয়া, সম্মানি থেকে আয়কর কর্তন না করা, ঠিকাদার, সরবরাহকারী এবং দোকান ভাড়ার বিল থেকে আয়কর কর্তন না করা এবং শিক্ষাছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান না করার পরও তাদের বেতন ভাতাদি দেওয়া ইত্যাদি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে এসব খাতের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও লুটপাটের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বছরের পর বছর অডিট আপত্তি ঝুলে থাকলেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। শুধু আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন আরও ২২ ধরনের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। বছরের পর বছর চলে আসা এসব অনৈতিক সুবিধা বন্ধ করতে শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় মাঝেমধ্যে শুদ্ধি অভিযানের কথা বললেও কার্যত কিছু হয়নি।

গত ১০ অক্টোবর শিক্ষা

\হমন্ত্রণালয়ের কাছে সিএজির পাঠানো অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাব সম্পর্কিত অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টের (এআইআর) উপর নিষ্পত্তিমূলক জবাব একাধিকবার চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এর আগে এক মাসের মধ্যে জবাব পাঠানোর কথা বলা হলেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দেয়নি। এর মধ্যে শুধু  ইউজিসি পাঁচটি অনুচ্ছেদের জবাব দিয়েছে। সিএজি আইইআর রিপোর্টে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ২৭টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ১৩টি অনুচ্ছেদকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তিমূলক জবাব প্রেরণের জন্য পুনরায় অনুরোধ জানানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব পাওয়া না গেলে ওই অনিয়মসমূহকে সঠিক হিসেবে গণ্য করে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (নিরীক্ষা আপত্তি) অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যেসব খাতে অডিট আপত্তি

ইউজিসির বার্ষিক প্রাপ্তি ও পরিশোধের হিসাব সম্পর্কিত বিবরণীতে অনলাইনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয়ের অপেক্ষা কম আয় প্রদর্শন করায় ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬৫ টাকা রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে। অভিযুক্ত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষার্থী ভর্তি ফরম বিক্রির কোনো অর্থ জমা না দিয়ে ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৭২ হাজার ৭০১ টাকা আত্মসাৎ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ভর্তির ফরম বিক্রির ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রাখতে হয়। দুই অর্থবছরে দুই ধরনের হিসাব বিবরণী  প্রণয়ন এবং কম আয় প্রদর্শন করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ১০ কোটি ৫০ লাখ ৮২ হাজার ৪৪২ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস করা সত্ত্বেও নির্ধারিত হার অপেক্ষা কম হারে বাড়ি ভাড়া কর্তন করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৬৫ হাজার ২৭৮ টাকা। অনিয়মিত অসম গ্রেডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেতন সমতাকরণের ফলে বেতন-ভাতা বাবদ অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে ৫৪ লাখ ১৪ হাজার ৬৯৩ টাকা। শিক্ষকদের মাসিক সর্বোচ্চ ১৫শ টাকার পরিবর্তে ৩৬শ থেকে ৪ হাজার টাকা হারে দায়িত্বভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ২ কোটি ২৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩০১ টাকা। বিধিবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মোবাইল ভাতা, যাতায়াত ভাতা, ডিন ভাতা, গবেষণা ভাতা, পরিচালক ভাতা, প্রোভোস্ট ভাতা, চেয়ারম্যান ভাতা ও জ্বালানি ভাতা প্রদান করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৭ কোটি ছয় লাখ ৫৪ হাজার ১৮৭ টাকা। শিক্ষকদের প্রাপ্য বই ভাতা ১২শ টাকার পরিবর্তে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা হারে প্রদান করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৮৮ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৭ টাকা। বিধি মোতাবেক প্রদত্ত সম্মানি হতে আয়কর কর্তন না করায় আয়কর বাবদ ৬০ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭২ টাকা  এবং দন্ডসুদ বাবদ ১৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯০ টাকাসহ সরকারের মোট আর্থিক ক্ষতি ৭৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯৬২ টাকা। ঠিকাদার, সরবরাহকারী এবং দোকান ভাড়ার বিল থেকে আয়কর কর্তন না করায় ৬৫ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৯ টাকা এবং দন্ডসুদ বাবদ ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬০ টাকাসহ সরকারের মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮০ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫৯ টাকা। বিধি মোতাবেক ঠিকাদার/সরবরাহকারী বিল থেকে ভ্যাট কম কর্তন করায় বা কর্তন না করায় ভ্যাট বাবদ ৩৩ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৭ টাকা এবং দন্ডসুদ বাবদ ৮ লাখ ১১ হাজার ১৭৭ টাকাসহ সরকারের মোট আর্থিক ক্ষতি ৪১ লাখ ৯১ হাজার ৭৪ টাকা। অননুমোদিতভাবে দুইজন শিক্ষককে শিক্ষাছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান না করা সত্ত্বেও বেতন-ভাতাদি দেওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৩২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৭০ টাকা। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সরবরাহকারীর কাছ থেকে বিভিন্ন মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে আয়কর কর্তন না করায় আয়কর বাবদ ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৪৩ টাকা এবং দন্ডসুদ বাবদ ৪১ হাজার তিন টাকাসহ সরকারের মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৮৪৬ টাকা। এই ১৩ দফায় মোট ৪৭ কোটি ১৬ লাখ তিন হাজার ৫৫৫ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সরকারের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে