আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার শূন্যেও কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষে প্রতিবছর বাজেটে তামাকজাত পণ্যের উপর শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। সরকারের এমন নীতিগত সিদ্ধান্তের পরও কমছে না তামাকের ব্যবহার। বরং নতুন নতুন কৌশলে তামাকজাত কোম্পানি প্রচার ও বিক্রি বাড়াচ্ছে। সরকারকে সর্বোচ্চ শুল্ক দেওয়া হয় এ খাত থেকে এমন অজুহাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক তামাকজাত কোম্পানিগুলো সরকারের উপর নানা ধরনের হস্তক্ষেপ বাড়াচ্ছে। এক গবেষণায় হস্তক্ষেপে এশিয়ার শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। আর বৈশ্বিক সূচকে ২৭তম। শুধু তাই নয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাদের কাছে অনেকটা নতি স্বীকার করেছে। 'তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক:এফসিটিসি আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ২০২০' গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বেসরকারি সংস্থা প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা বস্নুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিস এর স্টপ (স্টপিং টোব্যাকো অরগানাইজেশন্স অ্যান্ড প্রোডাক্টস) বিশ্বের ৫৭টি দেশে উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। সেখানে তারা দেখাতে চেয়েছেন, তামাকজাত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো কীভাবে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে বৈশ্বিকভাবে ২৭তম। আর এশিয়ার শীর্ষে। এ চিত্রকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতা করেছে গেস্নাবাল সেন্টার ফর গুড গভর্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি) ও থামাসাত ইউনিভার্সিটি থাইল্যান্ড। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালে কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপে সূচকে বাংলাদেশের স্কোর নিম্নমুখী হয়েছে। গবেষণায় সরকার তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপসমূহ কিভাবে আমলে নেয় এবং সেগুলো মোকাবিলায় কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এফসিটিসি আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ গাইডলাইনের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সূচকে স্কোর যত বেশি, হস্তক্ষেপ তত বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচির অজুহাতে তামাক কোম্পানিগুলো কোভিড-১৯ মহামারিকে শতভাগ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। তারা নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনের সঙ্গে মিশে নানাবিধ ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করছে। ফলে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর কমার বদলে বাড়ছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে তামাক কোম্পানিগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচির অজুহাতে নীতিনির্ধারক, সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে মিশে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় এবং তামাকনিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। একইসঙ্গে এসব সিএসআর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রচার করে কোম্পানিগুলো জনমনে নিজেদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির চেষ্টা করেছে। উদাহরণ দিয়ে প্রজ্ঞা বলেছে, গত বছর ২৫ অক্টোবর ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটিবি) বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর হাতে অনুদানের চেক হস্তান্তর করে। সেটি পরে সংবাদ ও ছবি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে প্রচার করা হয়। এভাবে তামাক কোম্পানিগুলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরকে ব্যবহার করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)-এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে এনবিআর জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, ২০১৯ চূড়ান্তকরণে তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। অথচ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ এ তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নীতি প্রণয়নে তামাক কোম্পানিকে কোনোভাবে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে নানামুখী চাপ সত্ত্বেও গবেষণা চলাকালীন পর্যন্ত জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, ২০১৯ এর খসড়া প্রণয়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণ করেনি। যা ইতিবাচক দিক। গবেষণার ফলাফলে আরও দেখা গেছে সরকারের রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিড়ি মালিকদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারির মাধ্যমে নন-ফিল্টার বিড়ির শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার থাকার পরও বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জাপান টোব্যাকো কর্তৃক বিপুল রাজস্ব প্রদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শিল্প মন্ত্রীর কাছে তামাকের ওপর 'যৌক্তিক' করারোপ করার অনুরোধ জানিয়েছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, তামাক অপরিহার্য পণ্য তবে শুধু মৃতু্যর জন্য, জীবনের জন্য নয়। এটি কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় থাকতে পারে না। এটি সংবিধানের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। এ জন্য তামাকপণ্যকে এই তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য জাতীয় সংসদে বেসরকারি সদস্য বিল জমা দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাবেক সমন্বয়ক মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, 'সরকার সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আশা করি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজ মন্ত্রণালয় ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালকে আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সচেতন করবে। যাতে চলমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়াসহ সব ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থাকা যায়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চেয়ারম্যান ও ঢাবির সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কোভিড-১৯ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে তামাক ব্যবহার কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এটা এমন একটা সমস্যা যার সমাধানে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয় বরং সব মন্ত্রণালয় মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। অনলাইনভিত্তিক জুম সফটওয়্যারের মাধ্যমে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।