শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাস্কর্য নিয়ে নতুন উত্তাপ

ফয়সাল খান
  ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:১৬
শুক্রবার ভাস্কর্যবিরোধী কর্মসূচিতে পুলিশের হাতে আটক এক ব্যাক্তি

করোনাকালে রাজনৈতিক তেমন কোনো কর্মসূচি না থাকলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সে উত্তাপ কম বেশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকটি ইসলামি সংগঠনের নেতারা সম্প্রতি ভাস্কর্য নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিলেও এতদিন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে তেমন কোনো বক্তব্য আসেনি। তবে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও ডক্টর হাছান মাহমুদসহ দলের শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে দলীয় নেতাকর্মীরা নানাভাবে ভাস্কর্যের পক্ষে কথা বললেও আজ থেকে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতারা। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে আজ সারাদেশে মানববন্ধন পালন করবে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ অন্য সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি পালন করা হবে বলে জানা গেছে। যদিও এর আগে থেকে বিক্ষিপ্তভাবে মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করেছে। আগামী ১ ডিসেম্বর সারাদেশে একযোগে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের করবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবরোধ শেষে শনিবার বিকালে এ ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা। একই দিন এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশের সংস্কৃতির প্রতি চ্যালেঞ্জ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, সরকারের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না, জনগণের শান্তি বিনষ্টের যেকোনো অপচেষ্টায় জনগণই রুখে দাঁড়াবে। দেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান এবং রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বক্তব্য বরদাশত করা হবে না। শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের একটি ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের। কিন্তু বিক্ষোভের মুখে ওই ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকেন তিনি। তবে ওই মাহফিলে ২০১৪ সালে এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশে মদিনা সনদ বাস্তবায়ন করা হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, মদিনা সনদে যদি দেশ চলে, তাহলে কোনো ভাস্কর্য থাকতে পারে না। মদিনা সনদে যদি দেশ চলে, ইসলামবিরোধী কোনো কাজ হতে পারবে না। কারণ উনি নিজে ঘোষণা করেছেন মদিনা সনদে দেশ চলবে। তিনি আরও বলেন, আমি কোনো পার্টির নাম বলছি না, কোনো নেতার নাম বলছি না। কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য স্থাপন করে, সর্বপ্রথম আমি আমার আব্বার ভাস্কর্যকে ছিঁড়ে, টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেব। এ সময় বাবুনগরী জানান, তিনি ও তার দল প্রধানমন্ত্রী বা কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধী নয়। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য নিয়ে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। প্রায় দুই মাস ধরে ঢাকার দোলাইরপাড় চত্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরি করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আসছিল ইসলামি দলগুলো। অক্টোবরের শুরু থেকেই ভাস্কর্য তৈরির প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি ইসলামি দল ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে। গত ১৩ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটাবে। তার ওই বক্তব্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে অস্বস্তি তৈরি করে। তার এই বক্তব্যের জবাবে শনিবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, যারা আবার শাপলা চত্বরের হুমকি দেয়, তাদের লজ্জা থাকা উচিত। লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল তারা, কোনো হুমকি কাজে আসবে না। সরকারের শক্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকা উচিত। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে হানিফ আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কোনো শক্তির ক্ষমতা নেই এটা ঠেকানোর। আপনারা যে ভাষায় কথা বলছেন, মহানবীর (সা.) সময়ে এমন করে কেউ বললে ইসলাম গ্রহণ করত না। আপনারা ভাস্কর্য নিয়ে কথা বলছেন, পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশে অনেক ভাস্কর্য আছে। সেখানে ভাস্কর্য নিয়ে কেউ কথা বলে না। মক্কা নগরীর মানুষই ভাস্কর্য নিয়ে কথা বলে না। আপনারা জঙ্গিদের ভাষায় কথা বলছেন। এটা পাকিস্তানের ইসলাম। এটা স্বাধীন রাষ্ট্র, এখানে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা বা রাজাকারদের হুমকি শোনার জন্য ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা হয়নি। এদিকে শনিবার শাহবাগ মোড়ে অস্থায়ী মঞ্চ থেকে ৭ দফা দাবি পেশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা। তাদের সাত দফা দাবির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতাকারী মামুনুল হক ও ফয়জুল করীমের দ্রম্নত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জেলা-উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ; সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বাংলাদেশে অবিলম্বে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উলেস্নখযোগ্য। অন্যদিকে, গত শুক্রবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দল। এ সময় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে বলপ্রয়োগ করতে দেখা গেছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় আলেমদের এক জরুরি সভায় নূর হোসাইন কাসেমী বলেছেন, প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী। তিনি বলেন, মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরী বানাতে দেওয়া হবে না। সরকার ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণবিরোধী ঈমানি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটি মহল অবিরতভাবে আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে বিষোদ?গার ও নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। এমনকি বরেণ্য শায়খুল হাদিস আলস্নামা আজিজুল হক (রহ.) ও মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিম (রহ.) সম্পর্কেও চরম আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে অবাস্তব ও ভিত্তিহীন প্রশ্ন তুলে পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা করছে। অনতিবিলম্বে এই অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে ইসলামবিরোধী প্রাণী বা আবক্ষ মানবভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে বলে জানান তিনি। নূর হোসাইন কাসেমীর প্রেস সচিব মুনির আহমদ গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, সভায় ওলামায়ে কেরাম বলেন, মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে কূটকৌশলের পার্থক্য তৈরি করে প্রাণী বা আবক্ষ মানবভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের মৃতু্যবার্ষিকীতে তার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য ও মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন বলেছেন, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ ধর্মপ্রাণ এবং ধর্মভীরু মুসলমান ছিলেন। ধর্মের প্রতি অনুরাগ তার চরিত্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। এই সময়ে আমরা দেখতে পাই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতছানি। তিনি যে উন্নয়নের মাধ্যমে মানবসেবার আদর্শ রেখে গেছেন তার পাশাপাশি উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ঢাকায় সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবীর আদলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের বিরোধিতার মুখে সেই ভাস্কর্য সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর আগে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশ পথে স্থাপিত লালনের ভাস্কর্য সরাতে হয়েছিল সরকারকে। ==

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে