শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভোজ্যতেলের দাম ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ

আহমেদ তোফায়েল
  ২৮ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১২:৫৩

দেশে গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেলের বাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা উদ্যোগও কোনো কাজে আসছে না। ভোজ্যতেলের দাম দেশে নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গতকাল খোলা সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে সর্বাধিক ১১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গরিবের রান্নার পাম তেল এক সপ্তাহে ৬ থেকে ৭ টাকা বেড়ে প্রতি লিটার ১০২ থেকে ১০৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। রিফাইনাররা ব্র্যান্ডের নতুন বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম আরও ৫ থেকে ৬ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। লিটার প্রতি নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাঁচ লিটার জারের দাম পড়বে ৫৭০ থেকে ৬শ' টাকা। নতুন বোতল যখন কয়েক দিনের মধ্যে মুদি দোকানগুলোতে পাওয়া যাবে তখন প্রতি জারে ৩০ টাকা বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হবে ভোক্তাদের। ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো চলতি মাসে দুইবার এবং গত তিন মাসে ছয় বার দাম বাড়িয়েছেন। ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিন তেল এবং পাম তেলের বর্তমান দাম গত নয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এক বছরের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। মেঘনা গ্রম্নপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের একাধিক এজেন্ট জানিয়েছেন, দোকানিরা এখন তাদের পুরনো স্টকের ভোজ্যতেল বিক্রি করছেন। দুই একদিনের মধ্যে বাজারে নতুন দামের ট্যাগসহ বোতল আসবে। রাজধানীর মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী মো. গোলাম রাব্বানী যায়যায়দিনকে বলেন, তারা এখন রিফাইনার থেকে খোলা সয়াবিন তেল নূ্যনতম ১০৬ টাকায় পাচ্ছেন। তারা সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন লিটার প্রতি ১০৮ থেকে ১০৯ টাকায়। সুপার পাম তেল মৌলভীবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৮ থেকে ১শ' টাকায়। তিনি আরও জানান, গত তিন সপ্তাহে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটার প্রতি বেড়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত। সিটি গ্রম্নপের পরিচালক (কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা যায়যায়দিনকে বলেন, গত সাত মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে রিফাইনাররা ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এদিকে তিন স্তরে নয়, শুধু আমদানি পর্যায়েই ভোজ্যতেলের সম্পূর্ণ ভ্যাট পরিশোধ করতে চান ব্যবসায়ীরা। এর ফলে ভোজ্যতেলের বেচাকেনায় বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানি বন্ধ হবে বলে মনে করছেন তারা। পাশাপাশি তেলের বাজারও স্থিতিশীল হবে। ব্যবসায়ীদের এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে ট্যারিফ কমিশনও। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে ভোজ্যতেলের ওপর শুধু আমদানি পর্যায়েই ভ্যাট নেওয়ার জন্য আবেদন দিয়েছিল ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু আমদানি পর্যায়েই প্রস্তাবিত ভ্যাট নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও। সুপারিশটি বহুদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পড়ে আছে। ট্যারিফ কমিশনে দেওয়া আবেদনে সংগঠনটি জানায়, বর্তমানে ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন, পাম ও পাম অলিন তেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি), উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বিক্রয় ও সরবরাহ পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। উৎপাদনকারী কোম্পানির ব্যবসায়ীরা জানান, ডিলারদের হয়রানি বন্ধে আগের মতো সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানি পর্যায়ে প্রতি টনে ট্যারিফ ভ্যাট ১৫ হাজার টাকা দিতে চান তারা। তিন স্তরে ভ্যাট দিলেও সরকার পাচ্ছে প্রতি টনে ১৩ হাজার ৯শ' ৯০ টাকা। আমদানি পর্যায়ে একসঙ্গে টনপ্রতি এক হাজার টাকা বাড়তি ভ্যাট দিয়েও সরবরাহ পর্যায়ে হয়রানি বন্ধ চান ব্যবসায়ীরা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত এক স্তরে ভ্যাট থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের দাম ও সরবরাহ অনেকটা স্থিতিশীল ছিল। তাই ব্যবসায়ীরা এক স্তরেই ভ্যাট পরিশোধ করতে চান। ১৫ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দেওয়া এক সুপারিশে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন জানায়, সম্প্রতি বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় কমিশনে এক বৈঠক হয়েছে। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপরিশোধিত সয়াবিন, পাম ও পাম অলিন আমদানি, উৎপাদন ও খুচরা ব্যবসায়ী এই তিন পর্যায়ের পরিবর্তে শুধু আমদানি পর্যায়েই ভোজ্যতেলের ভ্যাট নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর আগে গত জুন মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো এক সুপারিশে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন জানায়, ভোজ্যতেলের ভ্যাট তিন পর্যায়ের পরিবর্তে শুধু আমদানি পর্যায়ে প্রতি টনে ১৬ হাজার টাকা নেওয়া যেতে পারে। এতে বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ভোজ্যতেলে বিদ্যমান ভ্যাট আহরণ পদ্ধতিতে মূল্য স্থিতিশীল রাখা কঠিন। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের মূল্য প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। এর ফলে বর্তমান পদ্ধতিতে এ পণ্যের ভ্যাটের পরিমাণও পরিবর্তন হয়। তাছাড়া সরবরাহ ও খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট সমন্বয় করা অত্যন্ত কঠিন। এই পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ না করায় মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট না দিয়ে রেয়াতি হার ৫ শতাংশ ভ্যাট দিচ্ছে, যা মূল্য সংযোজনের চেয়ে অনেক বেশি। এতে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরবরাহ পর্যায়ে থাকা ব্যবসায়ীরা পণ্য নিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে আট লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও ১২ লাখ টন পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পাম তেল আমদানি হয়। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ৩০ শতাংশ বোতল ও প্যাকেটজাত এবং ৭০ শতাংশ খোলা বিক্রি হয়। পাম তেল ও পাম অলিনের ১০ শতাংশ বোতল ও প্যাকেটজাত এবং ৯০ শতাংশ খোলা বিক্রি হয়। এ বিষয়ে সিটি গ্রম্নপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, পরিবেশক, পাইকারি, খুচরাসহ সরবরাহ পর্যায়ে থাকা ব্যবসায়ীরা যথাযথ পদ্ধতিতে হিসাব রাখতে পারে না। সঠিক হিসাব না রাখতে পারার কারণে তারা হয়রানির শিকার হন। এ কারণে আমদানি পর্যায়ে সম্পূর্ণ ভ্যাট নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, ট্যারিফ ভ্যাট নিলে ভোজ্যতেলের বাজার মূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে