শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ পাচারকারী তিন হাজার দুদকের জালে মাত্র ৬০!

বিএফআইইউর তথ্য অনুযায়ী গত ৫ বছরে ৩ হাজার ২২৮ জন ওভার ইনভয়েস ও হুন্ডিসহ নানা অপকৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৫ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ০০:০২

মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহকারী বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য অনুযায়ী গত ৫ বছরে ৩ হাজার ২২৮ জন ওভার ইনভয়েস ও হুন্ডিসহ নানা অপকৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। এদের ব্যাপারে তারা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন এবং অর্থ পাচারের উৎস থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েছে। এর বাইরে বিএফআইইউ আরও ১৭৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিদেশ থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা সরবরাহ করেছে। অথচ এ বিপুলসংখ্যক অর্থ পাচারকারীর মধ্যে মাত্র ৬০ জন রাঘববোয়াল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়েছে। তাদের বাইরে অন্য কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জোরালো তৎপরতা শুরুর কথা শোনা যায়নি। দুদক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ এই ৬০ জনের পাচার করা টাকা ফেরত আনতে দুদক এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ ১৮টি দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিউচু্যয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে থাকা কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সাহায্য চেয়েও তারা আবেদন করেছে। সূত্র জানায়, এর মধ্যে ৩৫ জন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির অর্থ পাচারের রেকর্ডপত্র দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা হাতে পেয়েছেন। ওইসব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে আদালতে ট্রায়াল চলছে। প্রসঙ্গত, অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করে বিচারিক কার্যক্রম শুরুর জন্য দেশের পাঁচটি সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর মধ্যে ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা অনুসন্ধান ও তদন্ত করে দুদক। বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা তদন্ত করে এনবিআর। আর হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ পাচার হলে তা পুলিশের সিআইডি তদন্ত করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্তে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে গত পাঁচ বছরে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন সংস্থার কাছে ৩ হাজার ২২৮টি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। এর মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন সংশ্লিষ্ট ৫৭২টি প্রতিবেদন দুদকে পাঠানো হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনের সংখ্যা ২৯১টি। এছাড়া বিএফআইইউ গত পাঁচ বছরে সিআইডিতে ১ হাজার ৬৬৪টি, এনবিআরে ১৭৮টি ও অন্যান্য সংস্থায় ৫২৩টি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গেস্নাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। এছাড়া গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয় ২০১২ সালে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এ আইন সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। তবে বিভিন্ন গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি পণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য পরিশোধ (ওভার ইনভয়েসিং) ও রপ্তানি মূল্যের চেয়ে কম দেখিয়ে প্রকৃত মূল্য দেশে প্রত্যাবাসিত না করা (আন্ডার ইনভয়েসিং), আমদানিকৃত পণ্য দেশে না আনা বা কম আনা এবং হুন্ডিসহ বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া ক্রস বর্ডার ক্যাশ স্মাগলিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার সংঘটিত হয়। দুদক সূত্রে জানা গেছে, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ১৬০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। এবি ব্যাংকের মাধ্যমে দুবাইয়ের এডিসিবি ব্যাংকে জালিয়াতির মাধ্যমে ওয়াহিদুল হক ওই টাকা পাচার করেন। দুদকের তদন্তে এই টাকা পাচারের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। দুবাই থেকে ওই টাকা ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আরব আমিরাতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। একইভাবে অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধেও দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের বিষয়ে তদন্ত করছে দুদক। সেলিম প্রধানের পাচার করা টাকা দেশে ফেরাতে থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করেছে দুদক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আলোচিত কেরানি আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে ২৬৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে দুদক। অবৈধ সম্পদ অর্জন, মানি লন্ডারিং এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে চলতি বছরের ২৭ জুন ওই দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক দুটি মামলা করে। এরপর টাকা দেশে ফেরাতে অস্ট্রেলিয়ায় আবেদন করা হয়। কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের হোতা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিষয়েও দুদক তদন্ত করছে। পি কে হালদারের পাচার করা অর্থের মধ্যে ৬৫০ কোটি টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এই টাকা ফেরত আনতে আবেদন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক (বহিষ্কৃত) কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তে প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। তিনি মালয়েশিয়া ও ভারতে টাকা পাচার করেছেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। দুদকের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ৬০ ব্যক্তির পাচার করা টাকা দেশে ফেরাতে এরই মধ্যে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩ ডজন চিঠির জবাব পাওয়া গেছে। দুদকের উপ-পরিচালক মর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, মাত্র ৬০ জনের পাচারকৃত টাকা ফেরানোর জন্য চিঠি দেওয়া হলেও এ অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে এসব মানিলন্ডারাররা বেশিরভাগই বিদেশে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে এতটা সূক্ষ্ণ কৌশল অবলম্বন করেছে যে, তাদের টিকি ছোঁয়াও দুষ্কর। তাই তাদের অবৈধ অর্থের উৎসসহ সার্বিক বিষয়াদি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অর্থ পাচারকারীদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি তাদের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেন এই দুদক কর্মকর্তা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে