শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বারবার ছাড় পেয়েছেন অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক মনির

চোরাচালানের দায়ে তার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একাধিক মামলা হলেও কখনো তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়নি
ম সাখাওয়াত হোসেন
  ২৩ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ২৩ নভেম্বর ২০২০, ০০:৫৫
মনিরুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন মনির

দোকান কর্মচারী থেকে স্বর্ণ চোরাচালানিদের গডফাদার হয়ে ওঠা মনিরুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন মনির বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই বিপুল অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এতদিন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি চোরাচালানের দায়ে তার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একাধিক মামলা হলেও কখনো তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়নি। তার নামে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়েরকৃত মামলাও দীর্ঘদিন ধরে ঢিমেতালে পরিচালিত হয়েছে। এ অবস্থায় আকস্মিক তার অবৈধ অর্থবিত্ত ও অস্ত্রের সন্ধান এবং তাকে গ্রেপ্তারের ঘটনার নেপথ্য রহস্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মনিরের স্বর্ণ চোরাচালান, জাল-জালিয়াতি করে রাজউকের জমি হাতিয়ে নেওয়া ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়গুলো এতদিন কীভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অগোচরে ছিল তা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। দোকান কর্মচারী থেকে রাতারাতি হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে প্রভাবশালী কার কার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, তারা কে-কীভাবে তাকে এতদিন রক্ষা করেছে তাও অনেকের কাছে জিজ্ঞাসু হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছ থেকে এর কোনো সদুত্তর পাওয়া না গেলেও একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে বেশকিছু প্রশ্নের জবাব মিলেছে। জানা গেছে, সম্প্রতি দেশে সংঘটিত একটি রাজনৈতিক নাশকতার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে গোল্ডেন মনিরের কালো অধ্যায়ের বেশকিছু অজানা তথ্য বেরিয়ে আসে। এরপর গত কয়েকদিন ধরে একটি গোয়েন্দা সংস্থা গোপনে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ শুরু করে। খতিয়ে দেখা হয় তার বিশাল অবৈধ অর্থের উৎস। একই সঙ্গে তার রাজনৈতিক কানেকশনের ওপর কড়া নজরদারি শুরু করেন গোয়েন্দারা। এতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নাশকতার ঘটনায় অর্থের জোগান দেওয়ার তথ্য বেরিয়ে আসে। আর এরপরই তার বাড়িতে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচনকে ঘিরে গত ১২ নভেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ১৫ বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় যে ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশি রিমান্ডে এ নাশকতার অর্থের জোগানদাতা হিসেবে গোল্ডেন মনিরের নাম প্রকাশ করে। এ সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য-প্রমাণও তারা পুলিশকে দেয়, যা ক্রসচেক করে যথেষ্ট সত্যতা মিলেছে। যদিও বাস পোড়ানো মামলার তদন্ত ও সুপারভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো কথা স্বীকার করেননি। তবের্ যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, গোল্ডেন মনির একই রাজনৈতিক দলের অর্থের জোগানদাতা, এ ব্যাপারে বেশকিছু তথ্য তাদের হাতে রয়েছে। তবে তিনি রাজনৈতিক কোন ধরনের কর্মকান্ডের জন্য কী পরিমাণ অর্থ সরবরাহ করেছেন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। গোয়েন্দারা তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ সংক্রান্তের তথ্যে অনুসন্ধান করবেন। এদিকে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের পৃথক তিন মামলায় মনিরের বিরুদ্ধে পৃথক তিন মামলায় মোট ১১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রোববার অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের পৃথক দুই মামলায় ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আবু বক্কর সিদ্দিক এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক মাসুদ উর রহমান। আদালত সূত্র জানায়, বাড্ডা থানার অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের আলাদা দুটি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক ইয়াছিন গাজী সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে ৭ দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক আবু বকর সিদ্দিক ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক জানে আলম দুলাল সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে হাজির করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক মাসুদ উর রহমান শুনানি শেষে ৪ দিনের রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করে রিমান্ডের জোর দাবি জানায়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এর আগে সকালের্ যাব বাদী হয়ে মনিরের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন। র্ যাব-৩ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) বিনা রানী দাশ বলেন, 'অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখায় গ্রেপ্তার গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। তাছাড়া ১০ দেশের মুদ্রা রাখায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরেকটি মামলা হয়েছে। মোট তিন মামলা গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে বাড্ডা থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।' মেরুল বাড্ডার স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মনির এলাকায় বিএনপির অর্থের জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত হলে তার সঙ্গে প্রভাবশালী বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তার মেরুল বাড্ডার বাসায় তাদের অনেকেই নিয়মিত আসতেন। এ নিয়ে স্থানীয়রা নানা ধরনের কানাঘুষা করতেন। বিশেষ করে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেকটাই চোখে পড়ার মতো। এছাড়া ভূমি দখলে তিনি রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছ থেকে নানা সুবিধা নিতেন। বিনিময়ে তিনি তাদের দামি উপঢৌকন ও নগদ অর্থ দিতেন। তার বাসার মদের আড্ডায়ও তাদের অনেকে নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনিরের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে জানান, বাস পোড়ানোর ঘটনায় অর্থের জোগানদাতা হিসেবে তার নাম আসার বিষয়টিও ক'দিন আগে মনির জানতে পেরেছিলেন। এ কারণে তিনি তার ঘনিষ্ঠ সরকারদলীয় এমপি ও নেতাদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েছিলেন। তারা কেউ কেউ তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছিলেন। এ কারণে প্রথমদিকে তিনি আত্মগোপন করতে চাননি। তবে গোয়েন্দাদের গতিবিধি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাকে গ্রেপ্তার করতে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। আর এ কারণেই তিনি বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। র্ যাব সূত্র জানায়, অবৈধভাবে মনির হোসেন থেকে গোল্ডেন মনির হওয়ায় এ উত্থানের পেছনে কারা কারা জড়িত রয়েছে তাদের শনাক্তে কাজ করছের্ যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্(যাব)। র্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিলস্নাহ বলেন, মনির রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেখানে জাল স্ট্যাম্প, জাল সিল তৈরি করে ভুয়া দলিল করে রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে পস্নট ও জমি দখল করেছেন। এছাড়া তার বাসা থেকে দুটি এবং অটো কার সিলেকশন থেকে তিনটি অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়। এসব বিষয়ে আমরা সরকারের চারটি সংস্থাকে তথ্য সংগ্রহের জন্য অনুরোধ জানাব। তিনি বলেন, গোল্ডেন মনির দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন বা কী পরিমাণ সম্পদ তার রয়েছে সে বিষয়ে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অনুরোধ করা হবে। এছাড়া তিনি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে কসমেটিকস পণ্য ও চোরাচালানির মাধ্যমে কী পরিমাণ স্বর্ণ দেশে এনেছিলেন সে বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুসন্ধান করতে অনুরোধ জানাবের্ যাব। এদিকে অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি (প্রত্যেকটি তিন কোটি টাকা মূল্যের) আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে (বিআরটিএ) এবং ভূমি দখল করার বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) অনুসন্ধানের জন্য সুপারিশ করা হবে। আশিক বিলস্নাহ বলেন, 'গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পেয়েছি সেগুলোর্ যাবের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয় বিধায় আমরা সরকারের চার সংস্থাকে তদন্ত করতে অনুরোধ জানিয়েছি।' প্রসঙ্গত, শনিবার গোল্ডেন মনিরকে গ্রেপ্তারের পর তার হেফাজত থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি, বিদেশি মদ এবং ১০টি দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এছাড়া তার বাসা থেকে আট কেজি স্বর্ণ ও নগদ এক কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। \হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে