উদ্যোক্তা সংকটে স্থবির হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ

১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য থাকলেও হয়েছে মাত্র সাড়ে ৭ হাজার

প্রকাশ | ২২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২০, ১০:২৪

রেজা মাহমুদ
শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক

আইসিটি খাতে দক্ষ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সারাদেশে ৮টি হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হয়েছে; কিন্তু গত ৫ বছরে রাজধানীর একটি ছাড়া উদ্যোক্তা টানতে ব্যর্থ বাকি পার্কগুলো। দক্ষ জনবল পর্যাপ্ত মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং প্রযুক্তি ব্যবসা রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ায় এসব পার্কে বিনিয়োগে আগ্রহ নেই উদ্যোক্তাদের। এমনকি বিনিয়োগ করেও ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন অনেকেই। ফলে আইসিটি খাতে দক্ষ কর্মসংস্থান তৈরির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার ধারে-কাছে যেতে পারেনি পার্কগুলো। সংশ্লিষ্টদের মতে, আইসিটি খাতে জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে এসব পার্ক স্থাপন করা হলেও মূলত দক্ষ জনশক্তির অভাবেই উদ্যোক্তারা ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না। এতে ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেও কিছু দিন পর তা আবার বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। উদ্যোক্তাদের মতে, পার্কগুলোর প্রধান সমস্যা দক্ষ জনশক্তি। তাদের মতে, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গেমিং, ইন্টারনেট অব আইটেম (আইওটি), মেশিন লার্নিং, বিগ ডেটা প্রসেসিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বস্নকচেইন প্রযুক্তির মতো আধুনিক প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্টে দক্ষ কর্মীর সংকট সীমাহীন। উদ্যোক্তারা বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি সেক্টরের সাধারণ কাজ করতে পারে এমন জনবল কিছু থাকলেও উচ্চমানের কাজের ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের বেশ অভাব রয়েছে। তাদের অভিযোগ, ঢাকার বাইরের পার্কগুলোতে অবকাঠামো ও বিভিন্ন মৌলিক সুবিধার অভাব রয়েছে। এমনকি জেলা পর্যায়ের এসব পার্কে নেই উচ্চগতির ইন্টারনেট ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট উচ্চ প্রযুক্তির সুবিধা। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তুলনায় হাইটেক পার্কের স্পেস ভাড়া এবং অন্যান্য চার্জ তুলানামূলক অনেক বেশি বলেও অভিযোগ রয়েছে উদ্যোক্তাদের। এদিকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ছাড়া দেশের অন্য কোথাও উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আগ্রহ নেই। এ খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ ব্যবসা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা পার্কগুলোতে এ মুহূর্র্তে ব্যবসা লাভজনক নয়। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একদমই না। আর তাই ব্যবসায় টিকে থাকতে রাজধানী ছাড়া অন্যান্য বিকল্প ভাবনা উদ্যোক্তাদের নেই বলেও মনে করেন এসব ব্যবসায়ী। ডেলটা ডেভেলপমেন্ট সফটওয়্যার ফার্মের উদ্যোক্তা কাজী ইমরান জানান, তিনি সিলেট হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করেছিলেন; কিন্তু ঢাকার তুলনায় সিলেটে খরচ বেশি ও অন্যান্য সুবিধা না থাকায় তিনি রাজধানীর জনতা টাওয়ারে তার ফার্ম শিফট করে আনেন। তিনি অভিযোগ করেন, এসব পার্কের অধিকাংশ স্থানেই প্রয়োজনীয় উচ্চ প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নেই। হাই স্পিড ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া যায় না। অনেক পার্ক রয়েছে, যেখানে ব্যাংকিং সুবিধাও নেই। এছাড়া প্রবেশ ও প্রস্থান ফি, স্থানের ভাড়া এবং অন্যান্য পরিষেবা চার্জের জন্য এখনো ম্যানুয়ালি লেনদেন করতে হয়। এসব কারণে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন কিংবা ঢাকায় চলে এসেছেন। এদিকে ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় বৈঠকে; ঢাকা এবং অন্যান্য হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক (এসটিপি) এবং ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে পরবর্তী তিন বছরে ১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তবে পাঁচ বছরে মাত্র ৭ হাজার ৫শ' জন এই উচ্চ প্রযুক্তি বা হাইটেক পার্কগুলোতে কাজ পেয়েছে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সময়োপযোগী একটি বিষয়। তবে দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য পুরোপুরি বাস্তবসম্মত ছিল না। এসব পার্কে চাকরি পাওয়া সাড়ে ৭ হাজারের মধ্যে কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কেই রয়েছেন ৪ হাজার ২৯৬ জন। কর্মসংস্থানের এই শোচনীয় অবস্থার পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হোসনে আরা বেগম যায়যায়দিনকে বলেন, প্রযুক্তি খাতে রাতারাতি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার সুযোগ নেই, এজন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন এবং এ ধরনের জনশক্তি তৈরি করা একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর আগে কোনো জরিপ না করেই বিশাল এ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে সারাদেশে তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে। এছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে ১ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে এসব পার্কে জায়গা বরাদ্দ চেয়ে প্রচুর আবেদন রয়েছে, তাই বলা যাবে না উদ্যোক্তা সংকট রয়েছে। তাদের মতে ভবিষ্যতে এসব জায়গার মূল্যবৃদ্ধি পাবে এই আশঙ্কায় অবশ্য অনেকেই অগ্রিম আবেদন জমা দিয়ে রাখছেন। তবে জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কারণ অনেকেই জায়গা বরাদ্দের পরও তাদের ব্যবসা শুরু করেননি। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের (বিএইচটিপিএ) আওতায় আটটি পার্ক এবং ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো হলো ঢাকার জনতা টাওয়ার, কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক, যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, সিলেটের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক এবং রাজশাহী, চট্টগ্রামে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এবং বরিশাল ও মাগুরায় শেখ কামাল আইটি প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন কেন্দ্র। এই হাইটেক পার্কগুলিতে প্রায় ১৩ দশমিক ১৫ লাখ বর্গফুট (বর্গফুট) জায়গার এখন পর্যন্ত কেবল ৫ দশমিক ৪১ লাখ বর্গফুট ভাড়া নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ মোট জায়গার প্রায় ৫৯ শতাংশ ফাঁকা রয়েছে। এদিকে কর্তৃপক্ষ চলতি অর্থবছরের আরও ২.৮ লাখ বর্গফুট জায়গা বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। হাইটেক পার্কের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ১৬২ একর জমির পুরোটাই শূন্য পড়ে আছে, রাজশাহী পার্কের ১০টি ভবনের মধ্যে একটিতে এখনো কোনো উদ্যোক্তার দেখা নেই। বরিশাল ও মাগুরায় শেখ কামাল আইটি প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সেন্টারে গড়ে ২ লাখ ২৭ হাজার বর্গফুট জায়গা তৈরি করা হয়েছে; কিন্তু কোনো উদ্যোক্তা না থাকায় পুরো এলাকা খালি রয়ে গেছে। চট্টগ্রাম সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে প্রায় ১.২০ লাখ বর্গফুট জায়গা খালি রয়েছে। এ বিষয়ে বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বমানের অবকাঠামো ও দক্ষ জনবলের অভাব, ব্যাংক সেবার অভাব ইত্যাদি কারণে জাপানি এবং স্থানীয় কয়েকটি সংস্থা ঢাকার বাইরে ব্যবসা শুরু করলেও পরে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া দক্ষ লোকবলের অভাবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সাবেক সভাপতি এবং বিডিজবস ডটকমের সিইও ফাহিম মাশরুর বলেন, দেশের বেশিরভাগ আইটি সংস্থা ছোট, তারা ১০ থেকে ৫০ জনকে নিয়োগ দেয়। এ জাতীয় সংস্থাগুলো কেবল ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে চালানো যেতে পারে। সুতরাং তারা রাজধানীর বাইরে যেতে রাজি হবেন না। তবে পার্কগুলো নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব কিছু এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক। কিছুটা সময় লাগবে, তবে এখন ঢাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি ও উদ্যোক্তাদের জন্য ইতিবাচক।