আলোচনায় হাজী সেলিম

এবার জগন্নাথের তিব্বত হল উদ্ধার আন্দোলন

প্রকাশ | ৩০ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

মহিউদ্দিন রিফাত
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বেদখলে থাকা আবাসিক হলগুলো উদ্ধারের দাবিতে সরব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। অনলাইন থেকে শুরু করে রাজপথের কর্মসূচি মানববন্ধন-বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিচ্ছেন তারা। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে হল হাজী সেলিম দখল করে রেখেছেন সেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবিলম্বে যেন উদ্ধারের ব্যবস্থা নেয়। যতদিন পর্যন্ত প্রশাসন বেদখলে থাকা হল উদ্ধারে ব্যবস্থা না নেবে ততদিন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মাঠে থাকবে। রাজধানীর পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেনে ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠা জায়গায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) 'তিব্বত হল'। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অর্পিত সম্পত্তি শাখার (স্মারক জেপ্রঢা/অর্পিত/১১৮৩) তথ্য অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলকৃত ১২টি হলের মধ্যে 'তিব্বত হল' একটি। হলটি বর্তমানে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের দখলে। ২০০১ সালে হাজী সেলিম হলটির অবকাঠামো পরিবর্তন করে তার স্ত্রীর নামে 'গুলশান আরা সিটি মার্কেট' নামক বহুতল বিপণি বিতান তৈরি করেন। হলটি উদ্ধারে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় আন্দোলনে সরকারের উচ্চমহলের আশ্বাসের পরেও আজও তা বেখলে। ২০০৯ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ দাবি জানায়, 'প্রায় ১৪ হাজার বর্গফুটের যে খালি জায়গাটি (তিব্বত হল) অবৈধ দখলদার কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদেরকে উচ্ছেদ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা প্রতিষ্ঠাপূর্বক হল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ।' জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে নির্মাণের ডামাডোলে জগন্নাথের হলগুলো আজও বেদখলে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হলগুলো উদ্ধার কার্যক্রমের কোনো উদ্যোগ নেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, এগুলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কখনও মালিকানা ছিল না। এগুলো হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি, ছাত্ররা এখানে থাকত। পুরানো হলগুলো নিয়ে যে মামলা-মোকদ্দমা চলছে তা জগন্নাথের সাথে না। হলগুলোর মালিক হাজী সেলিমও না; হলগুলো তিনি তিন বেচা দিয়েছেন। সরকারের উচিত এগুলো উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেয়া। জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) বেদখলকৃত হলসমূহে ১৯৮৫ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বসবাস করে আসছিলেন। ওই বছরের ৮ ফেব্রম্নয়ারি আরমানিটোলায় স্থানীয়দের সঙ্গে শহীদ আব্দুর রহমান হলের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের পর তিনটি বাদে বাকি হলগুলো বন্ধ করে দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেইনের 'তিব্বত হল' একটি। শিক্ষার্থীরা নব্বইয়ের দশকে একবার হলটি ফেরত নিতে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা ওই ভবনের দোতলায় আগুন দিলে তখনকার অধ্যক্ষ ড. হাবিবুর রহমান শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনেন। পার্থ লেইনের বিভিন্ন স্থানে ২০১১ সাল পর্যন্ত 'তিব্বত হল' লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেলেও শিক্ষার্থীরা আর সেখানে ফিরতে পারেননি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা হলটি 'ঘেরাওয়ে' গেলে হাজী সেলিমের সমর্থকরা হামলা করে এবং পুলিশ লাঠিপেটা ও গুলি করে। ঐদিন ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দীন গুলিবিদ্ধসহ তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধার আন্দোলনে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, ওই সময় হাজী সেলিম তৎকালীন উপাচার্য ড. মেসবাহউদ্দিনের সাথে উপঢৌকন নিয়ে দেখা করেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হল উদ্ধারে আন্দোলন করে। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকেও এ হল উদ্ধারে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তা স্থিমিত হয়ে যায়। সরকারের উচিত এ জায়গা উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা। হল উদ্ধার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এফ এম শরীফুল ইসলাম বলেন, ২০১৪ সালে যখন আমাদের হল উদ্ধার আন্দোলন তীব্র তখন সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদকে আহ্বায়ক করে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হল উদ্ধার কমিটি গঠন করে। এ কমিটির আমিও একজন সদস্য। ২০০৬ সাল থেকে ২০১১-এর মধ্যে হাজী সেলিম গুলশান আরা সিটির অবকাঠামো পরিবর্তন করে দোকান হিসেবে পজিশন বিক্রি করে দেন। তখন হল উদ্ধার আন্দোলনে হাজার হাজার ব্যবসায়ীর সাথে আমাদের মুখোমুখি হতে হয়। তাই আমরা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবসায়ীদের সফঙ্গ পেরে উঠতে পারিনি। হল উদ্ধারে সরকার কর্তৃক গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হল উদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক জগন্নাথ কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক ভিপি ও ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারের জন্য একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি হল উদ্ধারও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এ বিষয়ে কোনো খোঁজ-খবর না রাখায় হলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গুলশান আরা সিটি মার্কেটের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাজী মো. মজিবুর রহমান বলেন, মার্কেটটি কখনও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল না। এটি যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছিল না এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সে সময়ে একটি চিঠিও দিয়েছে।