বিশ্ব স্ট্রোক দিবস আজ

দেশে স্ট্রোকের ঝুঁকিতে ৫ শতাংশ মানুষ

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
দেশে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা রক্ত চলাচল বন্ধজনিত সমস্যা, সংক্ষেপে ব্রেন স্ট্রোক ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতি হাজারে আক্রান্ত হওয়ার এই হার ১২ জন। ফলে বিশেষজ্ঞরা স্ট্রোকে আক্রান্তের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এখনই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে 'জয়েন দ্য মুভমেন্ট' শীর্ষক প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ দেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস-২০২০। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকের ধারণা স্ট্রোক হচ্ছে হৃদযন্ত্রের কোনো সমস্যা। কিন্তু এটি মূলত মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ। এতে রক্তনালির জটিলতার কারণে হঠাৎ মস্তিষ্কের একাংশ কার্যকারিতা হারায়। তবে আক্রান্তের পর গোল্ডেন আওয়ার তথা ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে সঠিক চিকিৎসাসেবা পেলে ৩০ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাসপাতালগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সেবা অবকাঠামো অপ্রতুল হওয়ায় অধিকাংশ রোগী সময়মতো সেবা পায় না। স্ট্রোকে আক্রান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সুমন রানা যায়যায়দিনকে বলেন, স্ট্রোক বিশ্বে দ্বিতীয় প্রধান মৃতু্যর কারণ। তাই রোগটির লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে যত দ্রম্নত সম্ভব চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত। স্টোকের লক্ষণগুলো হলো হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, চোখে ঝাঁপসা দেখা, মুখ বেঁকে যাওয়া বা চেহারা পরিবর্তন হওয়া, বাহু অবশ হওয়া ও কথা বলার সময় জড়তা চলে আসা প্রভৃতি। এ ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো দেখা দেওয়া মাত্র আতঙ্কিত না হয়ে রোগীকে গোল্ডেন টাইমের মধ্যে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস বা রক্ত সঞ্চালন নিয়মিত রাখতে প্রাথমিক চিকিৎসা যেমন- একদিকে কাত করে বালিশ ছাড়া মাথা নিচু করে শোয়ানো, চোখ ও মুখের যত্ন নেওয়া, প্রসাব আটকে গেলে চিকিৎসকের সহায়তায় প্রয়োজনে ক্যাথেটার পরানো ও দ্রম্নত সিটি স্ক্যান করে স্ট্রোকের ধরন নিশ্চিত করতে হবে। ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অরগানাইজেশনের সর্বশেষ তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ৪ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। প্রতি বছর বিশ্বে দেড় কোটি মানুষ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৫০ লাখ মারা যায় এবং ৫০ লাখ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নিচে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, ব্রেন স্ট্রোক সম্পূর্ণ প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য হওয়ায় শারীরিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এ ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এ জন্য স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে ফাস্টফুড জাতীয় খাদ্য গ্রহণ ও ধূমপান পরিহার, বস্নাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে অবহেলা না করে হাসপাতালে নেওয়া ও সর্বোপরি জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জন্সের দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরলেও তাদের স্নায়ুবিক চিকিৎসায় মাত্র ১৬০ জন নিউরোসার্জন রয়েছেন, যা প্রতি ১০ লাখ বা ১ মিলিয়ন জনসংখ্যার অনুপাতে ১ জন। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ১ জন করে নিউরোসার্জন রয়েছেন। সে হিসাবে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ১ হাজার ৬০০ নিউরোসার্জন প্রয়োজন। আর নূ্যনতম চাহিদায় প্রতি ৫ লাখ মানুষের জন্য ১ জন করে হলেও দরকার ৩০০ জন। নিউরোসার্জন্স সোসাইটির আরও কয়েকজন চিকিৎসক যায়যায়দিনকে বলেন, সারাদেশের রোগীদের জন্য শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্স হাসপাতাল ছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে এই রোগীদের জন্য ৬৩০টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে বিএসএমএমইউতে ১২৫, ঢামেকে ২৯০, মিটফোর্ডে ১২, ময়মনসিংহ মেডিকেলে ৮, চট্টগ্রামে ৯৫, রাজশাহীতে ৪০, কমবাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে (সিএমইএইচ) ৩০ এবং এর বাইরে বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০টি বেড ছাড়া কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে কিছু সংখ্যক শয্যা রয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে নিউরোসার্জারিতে বিভিন্ন সাব স্পেশালিস্ট যেমন- স্কালবেইজ, পেডিয়াট্রিক, ভাস্কুলার, এন্ডোসপিক ও অনকোলজির মতো ইউনিট চালু হচ্ছে। এটি বিশেষায়িত সেবা হওয়ায় এ রোগের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির দরকার পড়ছে। অথচ এখন পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া অধিকাংশ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রোগীর অনুপাতে প্রয়োজনীয় ক্রানিওটোটাম, হাইস্পিড ড্রিল, অপারেটিং মাইক্রোস্কোপ, এন্ডোসকোপ, নিউরো নেভিগেটর ও নিউরো ক্যাথল্যাব চালু নেই। এতে করে দেশের বেশিরভাগ রোগীকে নিউরোসার্জারি চিকিৎসা নিতে ঢাকায় আসতে হচ্ছে, যা তাদের জন্য বিড়ম্বনা ও প্রাণহানির বড় কারণ। ফলে নিউরো অ্যানেসথেশিয়া, নিউরোরেডিওলজি, নিউরোপ্যাথলজির মতো সহযোগী বিষয়গুলোকে সমানভাবে বিকশিত করে রোগীদের উন্নত সেবাদানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ছে।