ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা

হ লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে হ মিলগেটে সরকারের নির্ধারিত দাম অকার্যকর

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বাজারে উত্তাপ ছড়াচ্ছে ভোজ্যতেলের দাম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার মিল গেটে খোলা ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও মিল মালিকরা তা মানছেন না। ফলে পাইকারি বাজারেও কমছে না দাম। এর প্রভাবে বুধবার খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়। তবে বিক্রেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় এই সময়ে দেশেও সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরের বগ বাজারে ভোজ্যতেল কিনতে আসেন বেসরকারি কর্মকর্তা আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। যেখানে পাঁচ লিটার কিনতেন এখন কিনেছেন ২ লিটার। নিরুপায় হয়ে আয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কম কিনতে হচ্ছে তাকে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি খোলা পাম তেল ৯০ টাকা আর সয়াবিন তেল ১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর বোতলজাত তেল বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকা লিটার দরে। রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা। যা এক মাস আগেও ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৮০-৮৫ টাকা। দুই মাস আগে খুচরা মূল্য ছিল আরও ৫-৬ টাকা কম। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে খোলা সয়াবিন লিটারে বেড়েছে ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া খোলা পাম অয়েলের দাম লিটারে মাসের ব্যবধানে ১ দশমিক ২২ শতাংশ ও বছরের ব্যবধানে ৩২ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়েছে। কারওয়ান বাজারের এক খুচরা বিক্রেতা জানান, পাইকাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়াচ্ছে। এসবই তাদের কারসাজি। আসল কারণ হচ্ছে প্রতি বছর শীতে ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বাড়ায়। এবারও তাই হয়েছে। সংকট তৈরি করে অতি মুনাফা করার জন্য দাম বাড়াচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ছে। কারণ তাদের বেশি দরে কিনে আনতে হলে বেশি দরেই বিক্রি করতে হয়। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে মিল পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৯০ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয়নি। মিল পর্যায়ে প্রতি লিটার সয়াবিন ৯২-৯৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে পাইকারি ভোজ্যতেল বিক্রেতা ও পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম জানান, সয়াবিন তেলের পাইকারি দাম এখনো ৩৫৫০ টাকার মধ্যে আছে। কিন্তু মিলগেটে প্রতি মণের দাম চাওয়া হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ টাকা। তেলের সরবরাহ আদেশ পেতেও ২-৩ দিন দেরি হচ্ছে। ব্যবসায়ী হাশেমের বক্তব্য অনুযায়ী, এখন পাইকারিতে প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের দাম রয়েছে ৮৮ টাকা ৭৫ পয়সা। আর মিল মালিকরা নতুন দাম চাচ্ছেন ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে যোগ হবে পরিবহণ ব্যয় ও লভ্যাংশ। তবে প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে সয়াবিনের মজুত কমে যাওয়ার কারণেই মওসুমের শেষ দিকে এসে পণ্যটির দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা। আর ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াকেন্দ্রিক পাম তেলের দাম বাড়ছে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার কারণে। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাফা হায়দার বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে সরে গিয়ে লাতিন আমেরিকার বাজারগুলো থেকে সয়াবিন তেল কিনছে। এমনকি তারা আন্তর্জাতিক বাজারের ৫০ শতাংশই বুক করে ফেলেছে বলে শোনা যাচ্ছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় সয়াবিনের মজুত কমে যাওয়া ও খরায় নতুন আবাদ বিলম্বিত হওয়ার কারণেও দাম বাড়ছে। ব্রাজিল কিছুটা চড়া দামে পণ্য দিলেও আর্জেন্টিনা আপাতত রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বলে জানান মোস্তফা। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ৭৯৯ ডলারে (এফওবি) পৌঁছেছিল। নতুন বছরে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। চলতি বছরের মার্চের দিকে দাম নেমে আসে ৫৭৮ ডলারে। বছরের বাকি সময় সামান্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে চলতে থাকায় বাংলাদেশের বাজার ছিল স্থিতিশীল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন আবার প্রতি মেট্রিক টন ৭৫৯ ডলারে পৌঁছেছে। আগস্টের শুরুতে ৬৯০, সেপ্টেম্বরের শুরুতে ৭৩০ এবং অক্টোবরের শেষে দাম গিয়ে পৌঁছায় ৭৬০ ডলারে। এ হিসাবে পণ্যটির দাম গত দুই মাসে প্রতি মেট্রিক টনে ৩০ ডলার এবং তিন মাসে ৬০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশে ডলারের দাম ৮৫ টাকা ধরলেও এই তিন মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রতি মেট্রিক টনে আড়াই থেকে ৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে দেখা যায়, জাহাজিকরণের সময় সয়াবিন তেলের দাম প্রতি মেট্রিক টন ৭৬০ ডলারের মধ্যে থাকলে পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি দাম ৯০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ৮২ থেকে ৮৬ টাকার মধ্যে। পামওয়েলের দাম ছিল প্রতি লিটার ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে থাকে। অক্টোবরের শেষ পর্যায়ে এসে খুচরায় সয়াবিন তেল ৯৭ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পামওয়েলও বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম ১৬ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ৩২ শতাংশ বেড়েছে।