হুমকিতে বন্দর

দখলে-দূষণে মুমূর্র্ষু কর্ণফুলী

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম
কর্ণফুলী নদীর জমে থাকা আবর্জনা
দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদীর এখন বড়ই করুণ দশা। এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হলেও দখলে-দূষণে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস কর্ণফুলী নদীটি। দখল আর পলি জমে ভরাটের কারণে ৯০০ মিটার প্রস্থের নদী কমে হয়েছে ৫১০ মিটারে। পস্নাস্টিক-পলিথিন জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে প্রায় ২০ ফুট। পলিথিন আগ্রাসনে এবং নানা ধরনের অপচনশীল বর্জ্যে কর্ণফুলী নদীর প্রায় ২০ ফিট গভীরতা কমে গেছে। এছাড়া নদীর তীরবর্তী ৩০০ কলকারখানা ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদীতে পড়ায় পানি মারাত্মক দূষিত হয়েছে। কর্ণফুলী নদী রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শুক্রবার ও গতকাল শনিবার সাম্পানর্ যালিসহ দু'দিনের কর্মসূচিতে সমন্বিত উদ্যোগের ডাক দেন রাজনীতিক, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। স্থানীয়রা জানান, দখল, ভরাট, বর্জ্য, পলিথিনসহ নানাভাবে কর্ণফুলী হত্যার মহোৎসব চলছে। কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতু নির্মাণের আগে ১৯৯০ সালে উত্তাল কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার। সেতু হওয়ার পর থেকে চর জমার পাশাপাশি আশপাশে পাকা অবকাঠামো নির্মাণ করে ব্যাপক হারে ভরাট ও দখল করা হয়েছে নদীটি। ফলে সেতু এলাকায় নদীর প্রশস্ততা নেমে এসেছে অর্ধেকে। অব্যাহত নাব্য হ্রাসে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা খ্যাত সদরঘাট ১নং জেটি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় পড়েছে বিশাল চর। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে এখানে জাহাজ চলাচলও সীমিত। এছাড়া কর্ণফুলীর পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে আড়াইশ'রও বেশি স্থাপনা। সম্প্রতি কর্ণফুলী নদী এলাকা পরিদর্শনে এসে এর বর্তমান চিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে কর্ণফুলী নদীকে ঘিরেই চট্টগ্রাম বন্দরনগরী, সেই নদীটিই দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। চট্টগ্রাম বন্দর গর্বের জায়গা। বন্দরের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ইকোনমিক হাব। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। এই নদীকে হত্যা করা মানে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। কর্ণফুলী নদী রক্ষায় গত কয়েক বছরে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও সুফল মিলছে না। কর্ণফুলী নদীর তৃতীয় সেতুর আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় চলছে বস্তিবাণিজ্য্য। সদরঘাট থেকে পতেঙ্গার লালদিয়ার চরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। শাহ্‌ আমানত সেতুর পশ্চিম পাশে অবৈধভাবে তৈরি হয়েছে বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড। এখান থেকে মেরিনার্স রোড হয়ে ফিরিঙ্গি বাজার পর্যন্ত অংশে প্রতিদিনই চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। প্রতিদিনই নতুন নতুন করে হচ্ছে দখল। তৈরি হচ্ছে টিনশেডের ঘর, টং দোকানসহ নানা স্থাপনা। একই সঙ্গে আনু মাঝির ঘাট, মাঝির ঘাট, আদম ঘাট, লবণ ঘাট, বিবি মসজিদ লেন, বারিক বিল্ডিং মোড়ের ঘাট, সদরঘাট, লাইটারেজ জেটি ঘাট, কর্ণফুলী ঘাট পর্যন্ত পাড়ের অংশেও চলছে দখলের মহোৎসব। নদী খেকোদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করা হলেও মাঝপথে অভিযান থমকে যায়। প্রভাবশালীদের অসংখ্য স্থাপনা রয়ে গেছে অক্ষত। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণখ্যাত কর্ণফুলী নদীর তীরে আদালতের নির্দেশে ২ হাজার ২৮৯টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। ২০১৯ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রম্নয়ারি অভিযান পরিচালনা করে ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, প্রায় ১০ একর জায়গা উদ্ধার, পাঁচটি খালের মুখের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৯ মাসেও কোনো অভিযান হয়নি। সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট অভিযান পরিচালনা করে ২০০ কাঁচা ও সেমিপাকা ঘর, দোকান ভেঙে প্রায় ১০ একর ভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়। কর্ণফুলী নদী রক্ষায় তৈরি হওয়া নতুন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো অ্যাকশনে যায়নি তারা। কার্যক্রম শুরুর জন্য যে ফান্ড দরকার, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। \হকর্ণফুলীকে চট্টগ্রামের প্রাণ বলা হলেও সরকারি তালিকাতে এখানে অবৈধ দখলদার আছে দুই সহস্রাধিক। রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা থেকে পতেঙ্গাস্থ কর্ণফুলীর মুখ পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার স্থানজুড়ে অন্তত ৩০০টি কারখানা কিংবা শিল্পস্থাপনা রয়েছে। পেপার মিল, তেল শোধনাগার, পাওয়ার পস্ন্যাট, ট্যানারি, সার প্রস্তুতকারক, সাবান এবং সিমেন্ট কারখানাসহ অন্তত ৮৪টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ৭৪টি কারখানায় তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) থাকলেও উৎপাদন খরচ কমাতে মালিকরা সেগুলো ব্যবহার করছে না। মারাত্মক ক্ষতিকর সব বর্জ্যরে ভারে কর্ণফুলীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। তবে কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সু্যয়ারেজ বর্জ্য। চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬০ লাখ মানুষের সু্যয়ারেজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বর্জ্য ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্ট না থাকায় কর্ণফুলী নদীর পানি দূষণের প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম ওয়াসাকে দিয়ে তাই সু্যয়ারেজের একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। সেটির কোনো সুফল এখনো পায়নি কর্ণফুলী নদী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কর্ণফুলী না বাঁচলে চট্টগ্রাম বন্দর বাঁচবে না। চট্টগ্রাম বন্দর না বাঁচলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বাঁচবে না। তাই দেশের স্বার্থে কর্ণফুলীকে রক্ষা করতে হবে। সাবেক মেয়র ও মহানগরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দীন বলেন, পস্নাস্টিক ও পলিথিন আগ্রাসনে এবং নানা ধরনের অপচনশীল বর্জ্যে কর্ণফুলী নদীর প্রায় ২০ ফিট গভীরতা কমে গেছে। ২০ ফিটের এই পলেস্তারার কারণেই নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন চট্টগ্রাম ওয়াসার সু্যয়ারেজ সিস্টেম কর্ণফুলী নদীমুখী হবে কেন? তিনি বলেন, এই কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে চট্টগ্রাম বন্দর। তাদের বার্ষিক আয় ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তাদের তহবিল থেকে একটি নূ্যনতম অংশ যদি কর্ণফুলী রক্ষায় ও চট্টগ্রাম উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ হয় তাহলে কর্ণফুলী বাঁচবে এবং চট্টগ্রাম নগরীর চেহারা পাল্টে যাবে।