বৈধ পথে আসছে সোনা

৪৯ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ষ বাজেটে ভ্যাট প্রত্যাহারের ইতিবাচক প্রভাব আমদানিতে

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধ পথে সোনা আমদানি শুরু হয়েছে। ৪৯ বছরের ইতিহাসে দেশে বৈধ পথে এই প্রথম সোনা আমদানি হচ্ছে। এতদিন সোনা আমদানির কোনো নীতিমালা না থাকায় অধিকাংশ সোনা আসত অবৈধ পথে। আর অল্প কিছু আসত ব্যাগেজ রুলসের আওতায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে লাইসেন্স দেওয়ার পর আমদানির লাইসেন্সধারী দুই প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত ২৫ কেজি স্বর্ণ আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো- অরোসা গোল্ড করপোরেশন এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। অরোসা গোল্ড করপোরেশন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে সম্প্রতি ১৪ কেজি স্বর্ণ আমদানি করেছে আর ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এ বছরের জুনে ১১ কেজি সোনা আমদানি করে। জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ ছিল না। ওই বছর সরকার দেশের জুয়েলারি শিল্পের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করে। তাতে সোনা আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও ভ্যাট বেশি হওয়ার কারণে কেউ আমদানি করতে আগ্রহ দেখায়নি বলে যায়যায়দিনকে জানান বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তবে এবারের বাজেটে ভ্যাট কমানোয় অনেকেই আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান তিনি। আগরওয়ালা বলেন, বাজেটে অর্থমন্ত্রী সোনা আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের পক্ষ থেকে দুবাই থেকে ১১ কেজি সোনা আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। সেটি চলতি বছরের জুনে দেশে এসেছে। এটাই ৪৯ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে বৈধপথে প্রথম সোনা আমদানি। এর মধ্য দিয়ে দেশের জুয়েলারি \হশিল্পের ইতিহাসে একটি সোনালি অধ্যায়ের সূচনা হয়। এতদিন যে গোল্ড আসত, তা অবৈধ পথে। আর কিছু আসত ব্যাগেজ রুলসের আওতায়। এখন দেশে গোল্ডনির্ভর শিল্প গড়ে ওঠার প্রত্যাশা জানিয়ে আগরওয়ালা বলেন, কাঁচামাল আসা শুরু হলো, এখন এ খাত বিকশিত হবে। একটার পর একটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। সুতা আমদানি করে পোশাক তৈরি করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে যেমন বিদেশি মুদ্রা দেশে আসছে; ঠিক তেমনি গোল্ড দিয়ে তৈরি নানা ধরনের গহনা রপ্তানি করেও বিদেশি মুদ্রা আসবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার জুয়েলারি খাত থেকে ৫০০ কোটি টাকার বেশি কর পাবে বলে দেশের শীর্ষস্থানীয় এ গহনা ব্যবসায়ীর অনুমান। তিনি বলেন, 'আমাদের সুবিধা হচ্ছে, সস্তা শ্রম। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশে গোল্ডনির্ভর বড় বড় শিল্প গড়ে উঠবে। বিনিয়োগ বাড়বে; কর্মসংস্থান হবে। এভাবে আমরা জিডিপিতে ভূমিকা রাখতে চাই।' এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তবে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় ২০০ গ্রাম সোনা আমদানির যে সুযোগ আছে, সেটা এখন বন্ধ করতে হবে। যেহেতু বৈধ পথে সোনা আমদানি হচ্ছে, এখন আর এ রুলসের প্রয়োজন নেই।' জানা গেছে, স্বর্ণ নীতিমালায় দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য সোনা আমদানির 'গোল্ড ডিলার' নিয়োগের বিধান রাখা হয়। গোল্ড ডিলার নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের মার্চে বিজ্ঞপ্তি দেয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে ৫০ প্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি ব্যাংক আবেদন করলেও সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় মাত্র ১টি ব্যাংক ও ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে নবায়নযোগ্য দুই বছর মেয়াদি লাইসেন্স দেওয়া হয়। স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চতুর্থ প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, জুয়েলারি হাউজ, রত্ন গোল্ড কর্নার, অ্যারোসা গোল্ড করপোরেশন, আমিন জুয়েলার্স, শ্রীজা গোল্ড পেস্নস লিমিটেড, জড়োয়া হাউস প্রাইভেট লিমিটেড, মিলন বাজার, এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, এম কে ইন্টারন্যাশনাল, আমিন জুয়েলার্স লিমিটেড, বুরাক কমোডিটিস এক্সচেঞ্জ কোং, গোল্ডেন ওয়াল্ড জুয়েলার্স, রিয়া জুয়েলার্স, লক্ষ্ণী জুয়েলার্স, বিডিইএক্স গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড লিমিটেড, ডি ড্যামাস দ্য আর্ট অব জুয়েলারি এবং প্রিন্সেস গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড কটেজ লিমিটেড। এবারের বাজেটে সোনা আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করায় অনেকেই আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা জানান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নীতিমালার পর দেশে বৈধ পথে প্রথম সোনা আমদানি করে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। আগেও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশে প্রথম ও একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইএম ৪ এর মাধ্যমে রাফ বা অমসৃণ ডায়মন্ড আমদানি করে কাটিং ও পলিশিং করে পলিশড ডায়মন্ড বিদেশে রপ্তানি করছে। এখন ছয় প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপের অনুকূলে আরও সাড়ে ৫২ কেজি স্বর্ণ আমদানির আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের আরও ২০ হাজার গ্রাম স্বর্ণ আমদানির আবেদন বিবেচনাধীন, জুয়েলারি হাউসের ২ হাজার ৫০০ গ্রাম, রত্ন গোল্ড কর্নারের তিন হাজার গ্রাম, জড়োয়া হাউসের ১৪ হাজার গ্রাম, রিয়া জুয়েলার্সের ১২ হাজার গ্রাম এবং বিডিইএক্স গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ডের ১ হাজার গ্রামসহ সব মিলিয়ে ৫২ কেজি ৫০০ গ্রাম সোনা আমদানি বিবেচনাধীন রয়েছে। \হসোনা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সূত্র জানায়, বাজারে এখন সোনার প্রচুর চাহিদা। ব্যাংকিং জটিলতা যদি সহজ না করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে স্বর্ণ আমদানি কঠিন হবে জানিয়ে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, আমরা চাই যেন এই প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করা হয়। এদিকে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের কবলে পড়েছে বিশ্বের সোনার বাজার। এর মধ্যে দেশের বাজারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে মূল্যবান এ ধাতুটির দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে সপ্তাহখানেক ধরেই দাম বাড়ার গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, দেশেও হয়তো বাড়বে। সেটিই বাস্তবে রূপ দিলেন ব্যবসায়ীরা। নতুন করে সোনার দাম ভরিতে ২ হাজার ৩৩৩ টাকা বাড়িয়ে দিলেন তারা। এতে ভালো মানের, অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার অলঙ্কার কিনতে লাগবে ৭৬ হাজার ৩৪১ টাকা। এ ছাড়া ২১ ক্যারেট ৭৩ হাজার ১৯২ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৬৪ হাজার ৪৪৪ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার অলঙ্কারের ভরি বিক্রি হবে ৫৪ হাজার ১২১ টাকায়। নতুন দর বৃহস্পতিবার থেকে সারাদেশে কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর সোনার দাম ভরিতে সাড়ে ১ হাজার ৭৫০ টাকা বাড়িয়েছিল সমিতি। এর আগে ৬ আগস্ট প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়ে ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা হয়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সোনার দাম বাড়ার কারণ হিসেবে জুয়েলার্স সমিতির যুক্তি হচ্ছে, করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ ও আসন্ন মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউএস ডলারের নিম্নমুখী ভাব, তেলের দরপতন ও নানা জটিল অর্থনৈতিক সমীকরণের মধ্যেও চলতি বছর চার দফায় সোনার দাম কমানো হয়। তবে আন্তর্জাতিক ও দেশের বাজারে আবার সোনার দাম বেড়েছে। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সোনার দাম বাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।