শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে সরকার

সোহেল হায়দার চৌধুরী
  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

করোনা ও বন্যার অজুহাতে অতিমুনাফা লোভী মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা চালের মূল্য বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা ঠেকাতে সক্রিয় সরকার। এরই মধ্যে কয়েক ধাপে ধানের দাম কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে সংকট সৃষ্টি করার পাঁয়তারা শুরু করেছে একটি গোষ্ঠী। অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের একাধিক সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের বাজার অস্থিতিশীল করার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হলে 'কঠোর অবস্থান' নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। মিলমালিকরা চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত দরে চাল না দিলে সরকার শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে আমদানির উদ্যোগ নেবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য চাল আমদানি বা আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আগেই অনুমোদন নেওয়া রয়েছে। ফলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো বিলম্ব হবে না।

পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এরই মধ্যে মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া চালের বাজারে অস্থিরতা রোধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চালের মিল, আড়ত ও বাজারে অভিযান আরও জোরদার করেছে। খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করে চাল সরবরাহ না করায় অতিসম্প্রতি কুষ্টিয়ায় ২৬১ চালকল কালোতালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দিনাজপুর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার আরও বিপুলসংখ্যক চালকল মালিককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের যেসব চাতাল মালিকের বিরুদ্ধে ধান মজুত করে চাল উৎপাদন বন্ধ রাখার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত এ বছর সরকার প্রতি কেজি মোটা চালের সংগ্রহমূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করে মিল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু মিল মালিকরা চুক্তিমূল্যে সরকারকে চাল সরবরাহ করতে চাচ্ছে না। নানা অজুহাতে কেজিতে তিন থেকে চার টাকা বাড়তি দাম দাবি করছে। চিকন চালেও কেজিপ্রতি দুই-তিন টাকা বেশি চাইছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজারে বাড়তি দামে বিক্রির সুযোগ থাকায় মিলগুলো সরকারকে চাল দিচ্ছে না। বরং তারা খোলাবাজারে চাল বিক্রি করে বেশি লাভ তুলে নিচ্ছে। যদিও তারা তাদের এ অপতৎপরতার বিষয়টি স্বীকার না করে উল্টো চালের দাম বাড়ানোর দায় সরকারের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ত্রাণ বিতরণে সরকার মোটা চাল ব্যবহার করছে। তাতে চাহিদা বেড়েছে। তাই মোটা চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এখানে তাদের কারসাজির কিছু নেই।

এছাড়া চালের দাম বৃদ্ধির

জন্য মিলাররা উত্তরবঙ্গের চাতাল মালিকদের দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, উত্তরবঙ্গের চালকল ও চাতাল মালিকরা হাজার হাজার টন ধান মজুত করায় ধান সংকটে চালের দাম বেড়েছে। ধান মজুতের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের বহু চাতাল মালিক চাল উৎপাদনও বন্ধ রেখেছেন। ফলে কুষ্টিয়া মোকামে চালের বাড়তি চাহিদাসহ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে তারা চালের দাম বাড়িয়েছেন। এছাড়া দেশে ৩৫টি জেলায় চার দফা বন্যার প্রভাব চালের দরে পড়েছে।

তবে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে, বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের বড় অংশ মিলাররা নিজেরাও কিনে মজুত করেছেন। এছাড়া এখন প্রান্তিক কৃষকের হাতে ধান নেই। তাই ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে চালের দাম বাড়ছে, এ অজুহাত ঠিক নয়।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোয়েন্দাদের এ পর্যবেক্ষণ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে শিগগিরই চাতাল মালিক ও মিলারদের গুদামে অভিযান চালানো হবে। সেখানে অতিরিক্ত ধান-চাল মজুত পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে যে পরিমাণ ধান-চালের মজুত রয়েছে তা দিয়ে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে ৫ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাই দেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই।

খাদ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে সরকারের গুদামে ১৩ লাখ ৯৭ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চালের পরিমাণ ১০ লাখ ৯১ হাজার টন। আর গমের পরিমাণ ৩ লাখ ৬ হাজার টন। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। থাইল্যান্ড, ভারত ও ভিয়েতনামে প্রতি টন চালের মূল্য ৩৭৫ ডলার থেকে ৪৮৫ ডলার রয়েছে। ওই হিসাবে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৩২ টাকা থেকে ৪১ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। তাই অসাধু ব্যবসায়ীরাই যে চালের বাজার অস্থির করে তুলতে একের পর এক ফন্দি আটছে এটি স্পষ্ট।

প্রসঙ্গত, গত ৩০ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন বোরো ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তার মধ্যে ৬ লাখ টন ধান। পরে আরও ২ লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ৮ লাখ টন ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার কথা রয়েছে। ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়ে তা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চালানোর সিদ্ধান্ত ছিল। তবে সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত ধান-চাল না আসায় সরকারের বোরো সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা এখনো পূরণ হয়নি। কারণ চুক্তি অনুযায়ী চালকল মালিকরা (মিলার) সরকারকে চাল দিচ্ছেন না। বরং অনেক মিলার অবৈধ মজুত গড়ে তুলে বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। চালকল মালিকরা সরকারিভাবে চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। চালের বাজার বিষয়ে সরকার একের পর এক কঠোর বার্তা দিলেও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা তা আমলেই নিচ্ছেন না। বরং সরকার যতই কঠোর হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ততোই কৌশল বদলাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, এবারের মৌসুমে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হয়েছে। তাই মিলাররা বাড়তি দাম দাবি করলেই সরকার তা দেবে না। আর বাজার অস্থিতিশীল করা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী চাল আমদানি করা হবে। কৃষকদের স্বার্থ বজায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে ২০১৭ সালের মতো ঢালাওভাবে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<113438 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1