শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সংকট কাটবে দুই বছরে

পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে বাংলাদেশ

আলতাব হোসেন
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

রান্নাবান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহারের ইতিহাস বহু প্রাচীন। পেঁয়াজ রান্নাঘরের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ। স্বাদের বৈচিত্র্য আনতে ঝাঁঝালো পেঁয়াজের জুড়ি নেই। এই পেঁয়াজ নিয়ে বিতর্ক এবং সংকটও কম নয়। দেশে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়ায় মাঝে মাঝে সংকটে পড়তে হয় রসনাবিলাসী ও গৃহকর্ত্রীদের। আমদানি বন্ধ বা সীমিত হলে নাগালের বাইরে চলে যায় পেঁয়াজের দাম। এতে ত্যক্তবিরক্ত ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও সরকার। এবার সেই সংকট উতরানোর সময় এসেছে। দুই বছরেই পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।

শুধু তা-ই নয়, নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে চালের মতো পেঁয়াজ রপ্তানির চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কৃষকরা শীতকালে সাত জাতের পেঁয়াজ আবাদ করেন। আর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ করেন তিন জাতের। এবার কয়েকটি গ্রীষ্মকালীন নতুন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করেছেন দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা। নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল জাতের পেঁয়াজের আবাদ বাড়লে বাংলাদেশ পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ যায়যায়দিনকে বলেন, ধান-চাল, মাছ, মাংস, সবজি, আলু ও আম উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের চরাঞ্চলে পেঁয়াজের আবাদ বাড়ানো ও যেসব এলাকায় পেঁয়াজ ভালো হয়, সেসব এলাকায় উৎপাদন বাড়ানোর মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, আগামী দুই বছরেই পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ। এ বিষয়ক একটি মহাপরিকল্পনা কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে চাল, কয়লা ও কোরবানির গরু আমদানি নিষিদ্ধ করার পরই মাত্র দুই বছরে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। চাল ও মাংস উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। ধীরে ধীরে বিভিন্ন সেক্টরে স্বয়ংসম্পূর্ণতা তৈরি হচ্ছে। কৃষি গবেষকরা মনে করেন, কৃষকদের সামান্য প্রণোদনা ও উন্নতমানের পেঁয়াজের বীজ সরবরাহ করলে দুই বছরেই পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ফারাক খুবই সামান্য। বাংলাদেশকে বছরে গড়ে সর্বোচ্চ আট লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। বছরে গড়ে শুকনো পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ লাখ টন। গত বছর দেশে প্রায় সাড়ে ২৫ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩ লাখ টন। এক বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ টন। উৎপাদনে ঘাটতি এবং যথাযথ সংরক্ষণাগার না থাকায় দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংকট তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ যে ক'টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে তার মধ্যে প্রধানতম হলো ভারত। অনেক সময় মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক ও চীন থেকেও বাংলাদেশ পেঁয়াজ আমদানি করে। তবে সড়কপথে কম দামে প্রধানত ভারত থেকেই বেশির ভাগ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এ কারণেই পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে ভারত কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। গত বছরও ভারত তাদের দেশের চাহিদা মেটাতে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। গত বছর অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে নিজেদের চাহিদা মেটায় ভারত। গত বছর বাংলাদেশে রেকর্ড তিনশ টাকা ছাড়িয়ে ছিল পেঁয়াজের কেজি।

সম্প্রতি ভারত নিজেদের বাজার সামাল দিতে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে। এতে দেশে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে দ্বিগুণ হয়। আবার আগের এলসি করা পেঁয়াজ আসার খবরে দাম কিছুটা কমে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) অনলাইনে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করায় পরিস্থিতি পাল্টেছে দ্রম্নত। পেঁয়াজের অস্থির বাজার সুস্থির করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির আমদানিতে আরোপিত ৫ শতাংশ শুল্ক ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রত্যাহার করেছে সরকার। এর পাশাপাশি পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মেটানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ বলেন, বিএডিসির কাছে উন্নতমানের মুড়ি-পেঁয়াজের বীজ মজুত আছে চার টন। চাষিদের কাছে আছে ১ হাজার ৩৬৪ টন। বিদেশ থেকে বীজ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পেঁয়াজচাষি কৃষকদের সার ও বীজ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হবে। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিশেষয়ায়িত কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করা হবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. আবুল কালাম আযাদ যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশ শিগগিরই পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। গবেষকরা প্রথমবারের মতো কয়েকটি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এতদিন বাংলাদেশ কেবল শীতকালীন পেঁয়াজের আবাদ করত। নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল জাতের পেঁয়াজের আবাদ বাড়লে বাংলাদেশ পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। তিনি বলেন, বারি-৫ এবং ৬ উচ্চ ফলনশীল পেঁয়াজ হেক্টরপ্রতি ১৮ টনের বেশি ফলনে সক্ষম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত মৌসুমে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ টন। এই হিসেবে দুই বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়বে পাঁচ লাখ টন। তখন মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩০ লাখ টনের বেশি। দুই বছর পর চাহিদা বেড়ে সর্বোচ্চ ২৯ লাখ টন হতে পারে। দেশের কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পেলে মাত্র দুই বছরেই পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ। দুই বছর পর চাইলে বাংলাদেশ পেঁয়াজ রপ্তানিও করতে পারবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বিভাগের পরিচালক ড. আজাহার আলী বলেন, ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ ৭১ হাজার টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। আগামী অক্টোবর মাসের শুরুতে দেশে পেঁয়াজ চাষ শুরু হবে। এবার পেঁয়াজ চাষের আবাদি এলাকা বাড়ছে প্রায় দুই লাখ হেক্টর। চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১৫ লাখ হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে ১২ থেকে ১৩ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়। গত বছর ১৩ লাখ ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়। চলতি বছরের মধ্য ডিসেম্বরে আগাম মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করবে। মার্চ মাসের শুরুতে বাজারে শুকনা পেঁয়াজ পাওয়া যাবে।

সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক যায়যায়দিনকে বলেন, এক কেজি পেঁয়াজের বীজে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয়। একেক বিঘায় গড়ে ৪০ মণ দেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। গত বছর এক কেজি পেঁয়াজের বীজের দাম আড়াই হাজার টাকা, অর্থাৎ এক মণ পেঁয়াজের বীজের দাম এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এই বছর দুই লাখ টাকা দিয়েও এক মণ পেঁয়াজের বীজ পাওয়া যায়নি। আশা করা হচ্ছে, চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের উৎপাদন তিন লাখ টন বাড়বে। তিনি পেঁয়াজসহ কৃষিপণ্যের আগাম মূল্য নির্ধারণে একটি প্রাইস কমিশন গঠনের দাবি জানান।

কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর বলেন, বাংলাদেশে আলু সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজ থাকলেও পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোনো কোল্ডস্টোরেজ নেই। পেঁয়াজের জন্য ১২ থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের তাপমাত্রা দরকার। ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ীসহ দেশের যেসব এলাকায় পেঁয়াজের আবাদ বেশি হয়, সেখানে কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ জরুরি।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মাঠপর্যায়ে কৃষকরা শীতকালে সাত জাতের পেঁয়াজ আবাদ করেন। আর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ করেন তিন জাতের। দিন ছোট হওয়ার কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজের আকার ও উৎপাদন কিছু কম হয়। আফ্রিকার দেশগুলোতে হেক্টরপ্রতি পেঁয়াজের উৎপাদন হয় ২০ লাখ টন। সেখানে বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় গড়ে ১২ থেকে ১৩ লাখ টন।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) গবেষক আফজাল হোসেন বলেন, পেঁয়াজচাষি কৃষকদের ন্যায্য মূল্য, মৌসুমে পেঁয়াজের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা রাখা, কোল্ডস্টোরেজ বাড়িয়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতি এবং পেঁয়াজবীজের সরবরাহ বাড়ানো হলে আগামী দুই বছরে পেঁয়াজ উৎপাদনে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির হার গড়ে ১০ শতাংশ। এফএও বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। ২০১৯ সালে পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<113293 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1