গণফোরামের উত্থানপতনের নেপথ্যে ঐক্যফ্রন্ট!

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
১৯৯৩ সালের ২৯ আগস্ট ড. কামাল হোসেন নতুন রাজনৈতিক দল গণফোরাম গঠন করেন। ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ সাল দীর্ঘ ২৫ বছরে এই দলটি জনপ্রিয়তা বা মাঠপর্যায়ের শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতিতে কখনোই শক্তিশালী অবস্থানে ছিল না। তবে সীমিতসংখ্যক জনবল নিয়েও নিজেরা ছিল ঐক্যবদ্ধ। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ ৫টি রাজনৈতিক দল ও সুপরিচিত ব্যক্তিদের নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন জোটের শীর্ষ নেতা হওয়ার পরেই দলটির ব্যাপক উত্থান ঘটে। এরপর নির্বাচনে এই জোটের চরম ভরাডুবি এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তকে অমান্য করে সংসদে শপথ নেওয়াকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পাশাপাশি রাজনৈতিক জোটে অস্বস্তি শুরু হয়। সম্প্রতি দলটির কোন্দল চরমে পৌঁছেছে, যা প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর আহ্বান করা একটি বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে। গৃহবিবাদ থেকে বিভক্তির পথের আভাসে দলটির পতনঘণ্টার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের শেষ দিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপর হয়ে ওঠেন গণফোরামের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। কেউ এর পক্ষে আবার কেউ বিপক্ষে অবস্থান নেন। কট্টরপন্থিরা বিএনপির সঙ্গে কোনো ঐক্য না গড়তে চেষ্টা করেন। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত উদারমনা নেতারা বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য গড়ার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। এর বাইরে বিশেষ কাউন্সিলে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে জাতীয় সংসদে শপথ নেওয়ার পরও মোকাব্বির খানের উপস্থিতি নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন অনেকে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিককে বহিষ্কার করা হয়। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলের একটি বৃহৎ অংশ। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন অনেক সক্রিয় নেতা। কাউন্সিল শেষে নতুন কমিটিতে নির্বাচনের আগে দলে যোগ দেওয়া ড. রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক এবং অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে নির্বাহী সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়। এতে দলের নতুন আরেকটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ক্ষুব্ধ নেতারা রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে থাকেন। বিভক্ত উদারমনা একটি অংশের সঙ্গে কট্টরপন্থি নেতারা যোগসাজশ করে আরেকটি বৃহৎ বলয় তৈরির উদ্যোগ নেন। এই দুই অংশের মধ্যেই চলছে এখন কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনা। দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, মূলত সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়াকে কোণঠাসা করার জন্য এবং তাকে নাজেহাল করতেই শুরু থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। রেজা কিবরিয়ার গ্রহণযোগ্যতা আর পরিচিতি নিয়ে দলের একটি অংশের শঙ্কা রয়েছে। তারা মনে করছেন, দীর্ঘকালের জন্য দলের নেতৃত্ব তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। আবার অপর একটি অংশ বলছেন, দলের সাধারণ সম্পাদককে মৌখিক ও একাধিকবার লিখিতভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আহ্বান করার অনুরোধ করলেও তিনি দলের অফিসে হাজির না হয়ে মাসের পর মাস বিদেশে অবস্থান করে অফিসের বাইরে উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সংগঠনকে শক্তিশালী করতে দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান কোনো ভূমিকাই রাখেননি। জানা গেছে, গত বছরের ২৬ এপ্রিল পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে দুই অংশের বিভক্তি থেকে এই গৃহবিবাদের সূত্রপাত। এ নিয়ে বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। এবার বিক্ষুব্ধরা পৃথক বর্ধিত সভার আয়োজন করছে। ফলে নতুন করে কোন্দলের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিক্ষুব্ধরা বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা হচ্ছে না। তাই দলকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। অন্যদিকে এই সভাকে অগঠনতান্ত্রিক বলে দাবি করেছেন গণফোরাম কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা আর বিশৃঙ্খলায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ দলটির প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন শেষ পর্যন্ত গত মার্চের শুরুতে কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিয়ে গঠন করেন সত্তর সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি। এ কমিটিতেও ড. কামাল হোসেন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া রয়েছেন। এছাড়া অন্য সবাইকে সদস্য করা হয়েছে। পরে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এই আহ্বায়ক কমিটিকে আর পূর্ণাঙ্গ করতে পারেননি নেতারা। সঙ্গত কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতারা। দলকে চাঙা করতে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়ে এবার নতুন কৌশলে এগোতে চাইছেন তারা। এর অংশ হিসেবে আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে। এই বর্ধিত সভার সঙ্গে রয়েছেন গত কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুর মতো সিনিয়র নেতারা। তবে গণফোরামের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই সভার সঙ্গে গণফোরামের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। দলটির সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ এরকম বর্ধিত সভা আহ্বান করতে পারেন না। এটা সম্পূর্র্ণভাবে গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ। তবে যে কারও রাজনীতি করার অধিকার আছে। কিন্তু গণফোরামের নাম ব্যবহার করে কোনো সভা করার অধিকার কারও নেই। কথিত ওই সভায় গণফোরামের কোনো জেলা কমিটির নেতারা আসবেন না। প্রত্যেকটা জেলা কমিটির নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। জেলার নেতারা জানিয়েছেন, তারা ওই সভায় যাবেন না। ড. রেজা কিবরিয়ার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ড. রেজা কিবরিয়া নিজেইতো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা করছেন না। গঠনতন্ত্রে আছে ৩০ দিনে সম্পাদক পরিষদ, ৬০ দিনে স্থায়ী কমিটি এবং ৯০ দিনে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করতে হবে। ১০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার এক বছরের মধ্যে একটি বৈঠকও করা হয়নি। এসব বৈঠক আহ্বান করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির ৭০ জন সদস্য লিখিতভাবে চিঠি দিয়েছে। উল্টো তাদের মধ্যে ১৩ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ এবং ৪ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এভাবেতো দল চলতে পারে না। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। চরম স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে বেরিয়ে আসা সাধারণ সম্পাদক সাইফ উদ্দিন আহমেদ মানিককে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গণফোরাম গঠন করেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মানিক মারা গেলে আওয়ামী যুবলীগ থেকে আসা মোস্তফা মহসিন মন্টুকে দলটির সাধারণ সম্পাদক করা হয়। দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল। একাদশ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে গণফোরামের 'উদীয়মান সূর্য' প্রতীক নিয়ে সিলেট-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোকাব্বির খান।