শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ চক্রের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

করোনার প্রকৃত চিত্র নিয়ে সংশয়

যাযাদি ডেস্ক
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
সংক্রমণের ভয় এড়িয়ে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে কর্মব্যস্ত মানুষ -ফাইল ছবি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দৈনিক শনাক্ত রোগীর যে পরিসংখ্যান প্রতিদিন দিচ্ছে, তাতে সংক্রমণ কমে আসার একটি ধারণা মনে জাগলেও দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসায় ওই পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্র দিচ্ছে কিনা সেই সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মনে।

যারা নিজে থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন, কেবল তাদের তথ্যই সরকারি খাতায় আসছে। যাদের উপসর্গ সেভাবে নেই, তারা হিসাবের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। জনসংখ্যার অনুপাতে দেশের কোন এলাকায় কতটা ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস, সেই বিশ্লেষণও জানা যাচ্ছে না ওই পরিসংখ্যান থেকে।

কাজেই পরীক্ষা বাড়িয়ে সঠিক চিত্র তুলে আনার ব্যবস্থা না হলে বাংলাদেশ 'দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ চক্রে' পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা ডা. বে-নজির আহমেদ।

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন যে প্রতিবেদনটা দিচ্ছে, সেখানে সংক্রমণের মাত্রাটা কমছে। কিন্তু মহামারির প্রকৃত চিত্রটা আমরা পাচ্ছি না। কোথায় সংক্রমণ বাড়ছে, কোথায় কমছে- আমরা জানি না। আমরা অ্যান্টিবডি টেস্ট করছি না। অ্যান্টিবডি টেস্ট দিলে বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণের অবস্থাটা দেখতে পাব।'

বাংলাদেশে মহামারির শুরু থেকে কেবল

আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে করোনাভাইরাস শনাক্তের কাজ চলছে। এই পরীক্ষা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ, তবে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত।

অন্যদিকে অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় জানা যায়, কারও শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না। অর্থাৎ যারা আক্রান্ত হলেও উপসর্গহীন (অ্যাসিম্পটোম্যাটিক) ছিলেন এবং সেরে উঠেছেন, তাদের অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব। আর তা করা গেলে জানা যাবে করোনাভাইরাস আসলে কতটা ছড়িয়েছে।

বে-নজির আহমেদ বলেন, 'আক্রান্তরা যাদের সংস্পর্শে গিয়েছিল, তাদের ট্রেসিং হচ্ছে না। ট্রেসিং এবং ট্রেসিংপরবর্তী টেস্ট করানো হচ্ছে না। ট্রেসিং করে যদি টেস্ট করা হতো, তখন প্রকৃত সংখ্যাটা বলতে পারতাম।'

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্যর্ যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহারের অনুমতি দিলেও অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন এখনো দেওয়া হয়নি।

বে-নজির আহমেদ বলেন, 'মহামারি হলে এটা করতে হয়। সব দেশেই করছে। কিন্তু আমাদের এখানে যারা টেস্ট করাতে চাচ্ছে, শুধু তাদেরই করা হচ্ছে। ৩০ শতাংশ লোক যদি উপসর্গহীন হয়, যদি তাদের ট্রেসিং না করা হয়; তাহলে যে সংখ্যাটা আমরা পাচ্ছি, সেটা কিন্তু প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তুলছে না।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত সময়ে দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজারের ঘরে। সেপ্টেম্বরে তা কমে এসে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজারের ঘরে থাকছে।

এই সময়ে দেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার আরটি-পিসিআর ল্যাব বাড়লেও দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। জুনের শেষ আর জুলাইয়ের শুরুতে দৈনিক ১৭ থেকে ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল, এখন তা ঘোরাফেরা করছে ১১ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে।

সর্বশেষ যে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিয়েছে তাতে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আরও ১ হাজার ৬৬৬ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৪ জনে। এক দিনে আরও ৩৭ জনের মৃতু্য হওয়ায় দেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ হাজার ৪৪ জন হয়েছে।

সরকারি হিসাবে 'প্রকৃত আক্রান্তের তুলনায় কম শনাক্তের তথ্য আসায়' মানুষের মধ্যে 'সতর্কতায় ঘাটতি' তৈরি হচ্ছে এবং তাতে ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা বে-নজির।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিধিটা হলো জনগণের বিষয়, আর সরকারের বিষয় হলো ট্রেসিং, টেস্টিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন। এগুলো ঠিকমতো করলে স্বাস্থ্যবিধিতে বিচু্যতি ঘটলেও সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যাবে।

সেজন্য 'যথাযথ ব্যবস্থাপনা'র ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, সবার পক্ষে সেলফ কোয়ারেন্টিন সম্ভব না। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ, একদিন অফিসে না গেলে চাকরি থাকবে না, সে তখন ওষুধ খাবে, রোগটা লুকিয়ে রেখে চলাচল করবে, তাতে আরও বেশি ছড়াবে।

সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও 'ভুল অ্যাপ্রোচের' কারণে ভাইরাসের বিস্তার 'আসলে কমানো যাচ্ছে না' বলে মন্তব্য করেন বে-নজির আহমেদ।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা সংক্রমণ কমাতে পারিনি। কিন্তু মনে করছি, আমরা সংক্রমণ কমিয়েছি, আমরা ভালো করছি। এভাবে নিজেদের ক্ষতি করছি। অন্য দেশগুলো এগোচ্ছে ভিন্নভাবে। আমরা দুই মাসে এটাকে শূন্যতে নামাতে পারলে একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু ৬ মাস পরও বাস্তবে একইরকম আছে। ফলে আমরা দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। শীতের আগে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, ভালো কিছু হবে না।'

মার্চের শুরুতে ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ তাহলে এখন মহামারির কোন পর্যায়ে আছে?

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ বলেন, 'সব মিলিয়ে আমরা একটা হতচ্ছাড়া অবস্থায় আছি। এভাবে চললে আমরা তো এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবই না, বরং দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমণের দিকে যাব।'

এদিকে ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে সংক্রমণের 'দ্বিতীয় ঢেউ' নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। খোদ সরকারপ্রধান আসন্ন শীত মৌসুমে ভাইরাসের প্রকোপ আবার বাড়তে পারে বলে সতর্ক করে সেজন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে একই ধরনের আশঙ্কার কথা বলেছে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. বে-নজির বলেন, 'দেশে ফার্স্ট ওয়েভই এখনও শেষ হয়নি। ইউরোপের অনেক দেশ বা চীন তো দৈনিক শনাক্ত রোগী শূন্যতে নামিয়ে আনল। আমরা ছয় মাসেও এটা পারলাম না। আমরা এটাকে বলছি, ওয়েভ ইমপোজড। অর্থাৎ যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে যে ঢেউটা আছে, সেটার ওপর আরেকটা ঢেউ পড়বে। মানে আমরা নিচে পড়ে যাব।

মহামারি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘ সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছেন করোনাভাইরাস সংকটে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ সহায়তা দিয়ে আসা ডা. মুশতাক হোসেনও।

তিনি বলেন, 'আমরা যত বেশি শনাক্ত করব, তাদের আইসোলেশন করা ও কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে মহামারি নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হবে। কিন্তু এগুলো হচ্ছে না। এভাবে হাল ছেড়ে দিলে সংক্রমণটা আবার বাড়বে। যদি আমরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করি, তাহলে সেকেন্ড ওয়েভটা অনেক বড় হবে।'

বিদেশে কীভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে ক্যামব্রিজের পিএইচডি ডিগ্রিধারী মুশতাক বলেন, 'যারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে, তারা স্থানীয় সরকারকে কাজে লাগিয়েই তা করেছে। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ করেছে। চীন নিয়ন্ত্রণ করতে পারল কমিউন সিস্টেমের মাধ্যমে, আমাদের জেলা পর্যায়েও সে ক্ষমতা নাই।

এই সক্ষমতা হঠাৎ বাড়ানো যাবে না। তবে ডাক্তার নিয়োগ করে, বাজেট দিয়ে, স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে পরীক্ষা বাড়ানোর চেষ্টা করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। আমরা যদি মনে করি, করোনাভাইরাস চলে যাক, আমরা আগের মতো চলব, তাহলে সেটা অনেক বড় ভুল হবে।

\হদৈনিক মৃতু্যর সংখ্যার সঙ্গেও সংক্রমণের একটি সম্পর্ক আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'সেপ্টেম্বর থেকে শনাক্তের হারটা কম। যদি মৃতু্যর হারটা না কমে, তাহলে বলতে হবে সংক্রমণ খুব একটা কমেনি। মৃতু্যর সংখ্যাটা কিন্তু মোর রিলায়েবল। কিন্তু টেস্ট যদি বেশি না হয় বা মানুষ যদি টেস্ট করতে না আসে, তাহলে সংক্রমণের হারটা বোঝা যাবে না।

মহামারির এই পর্যায়ে তাহলে বাংলাদেশের কী করা উচিত? মুশতাক হোসেনের পরামর্শ, সবার আগে দুটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

প্রথমত সরকারের পক্ষ থেকে আক্রান্তদের আইসোলেশন সেন্টারে নেওয়া ও তাদের সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন করা। এজন্য আর্থ-সামাজিক সহায়তা দরকার হবে, না হলে মানুষ উৎসাহিত হবে না। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য তৃণমূল পর্যায়েও সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সহায়তা দিতে হবে সরকারকে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর অবশ্য মনে করেন, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়লে দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার আরও কমে আসবে।

সরকার পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে জানিয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, 'অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হলে যেসব জায়গায় পিসিআর এখনও পৌঁছেনি বা দেরি হচ্ছে রেজাল্ট দিতে, সেসব এলাকায় টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। তবে মানুষকেও সচেতন হতে হবে।'

তবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার বাইরে লকডাউনের মতো কড়াকড়ি আরোপের কথা আপাতত ভাবছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, যেহেতু হারটা এখন কমের দিকে, আর জীবিকা নিয়েই মানুষ বেশি চিন্তিত, সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে যে সচেতনতার বার্তা আছে, সেটা চলবে। কিন্তু আইনগতভাবে কড়াকড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা এখন নাই। বিডিনিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<113202 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1