শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশীর্বাদের বন্যা এখন অভিশাপ

আলতাব হোসেন
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০
বন্যায় পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। পাশাপাশি গবাদি পশু নিয়েও ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। ছবিতে ছাগল নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাত্রা করেছে বানভাসি একটি পরিবার -ফাইল ছবি

প্রকৃতিগতভাবেই ভাটি দেশ বাংলাদেশ। প্রতি বছরই ছোট আকারের বন্যা হতো। বন্যা এক সময় বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই গণ্য হতো। ছোটবন্যা প্রকৃতিনির্ভর কৃষির জন্য ছিল উপকারী। বর্ষার বন্যায় উজান থেকে বয়ে আনা পলি সমতলে ছড়িয়ে মাটির উবর্রতা বাড়াত। বন্যার পরের বছর বাম্পার ফলন হতো। নদীবাহিত পলি জমেই এই বদ্বীপের জন্ম। বৈশ্বিক জলবায়ুর বৈরী প্রভাবে দিনের পর দিন বন্যা হয়ে ওঠছে অভিশাপ।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাম্প্রতিককালে ঘনঘন বড় বন্যা হচ্ছে। অসময়ে প্রলংয়করী বন্যার কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। বন্যায় ফসল, গবাদি পশু এবং অবকাঠামোসহ অন্যান্য সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশে সাত থেকে দশ বছর পর পর বড় বন্যা হানা দিত। প্রকৃতির এখন তার ব্যাকরণ ভুলে প্রায় প্রতি বছরই বড় বন্যা হয়ে আঘাত হানছে।

বিশ্বের বন্যাপরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট 'ক্লাইমেট সেন্ট্রাল'। এই প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বন্যার আঘাতের শিকার হবে বাংলাদেশের চার কোটি ২০ লাখ মানুষ। আগে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের ওপর যতটুকু পড়বে বলে ভাবা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে এই প্রভাব হবে আরও অনেক ভয়ানক। বাংলাদেশে এই প্রভাবের শিকার মানুষের সংখ্যা হবে প্রায় পাঁচ কোটি ৭০ লাখ।

ব্রিটিশ বিজ্ঞান জার্নাল 'ন্যাচার-২০২০' এর এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি শতকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৫০ লাখের মতো মানুষ বন্যার শিকার হবে। সমুদ্রের উপরিতলের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে এ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এশিয়ার তিন কোটি মানুষ হুমকির মুখে পড়বে জলবায়ুর পরিবর্তন-প্রভাবের ফলে। আগে যেমনটি

ভাবা হতো তার চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ এখন সমুদ্রের উপরিতলের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে হুমকিতে পড়বে।

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যার পানির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ভারত, নেপাল ও চীন। বন্যার সময় এসব দেশ থেকে ধেয়ে আসা পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। উজানের দেশগুলো থেকে বয়ে আসা পানি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। বন্যার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের বসবাস যেন গলাগলি হয়ে পড়ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে।

সম্প্রতি ২০২০ সালের বন্যায় দেশের ৪০ জেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার ৯২৭ কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৬ টাকার ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, সিলেট, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর, নাটোর, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ ও পাবনা। প্রায় দুই মাসব্যাপী স্থায়ী বন্যায় দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা পস্নাবিত হয়। আগের বছর ২০১৯ সালেও ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে অক্টোবরে বড় বন্যা হয়। বাংলাদেশে ২০১৭ সালের বন্যাও ভয়াবহ পর্যায়ের ছিল।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার কামাল বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণেই এখন বেশি বন্যা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয় ১৯৯৮ সালে যাতে দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় পস্নাবিত হয়। গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা প্রলয়ঙ্করী হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা একসঙ্গে সক্রিয় হওয়ায় বড় বন্যা হয়। ১৯৮৭ সালে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি আর ১৯৮৮ সালে ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা পস্নাবিত হয়।

জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও উজানের দেশের অতিবৃষ্টি বন্যার প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। বাংলাদেশে ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৫, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭, ২০১৯, ২০২০ সালের বন্যায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের বন্যায় বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখন্ড বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সারা দেশের ৫৫ শতাংশের বেশি ভূখন্ড বন্যায় পস্নাবিত হয়। বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যা হয় চীনে ১৯৩১ সালে। ওই বন্যায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষের মৃতু্য হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বড় ধরনের বন্যা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বৃষ্টি বাড়ছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পলি পড়ার পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়ছে। ফলে নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে আসছে। এ কারণে উজানের ঢল এলেই তা বন্যায় পরিণত হচ্ছে। প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় আট লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। যা বার্ষিক মোট প্রবাহের ৯৫ শতাংশ। তুলনায় একই সময় দেশের অভ্যন্তরে এক লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদী প্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।

সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালের ২০২০ সালের জুনে প্রকাশিত এক নতুন সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জলবায়ুর প্রভাবে আগামী ৮০ বছরে বন্যার পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং এর ফলে লাখ লাখ উপকূলবাসী বিপদের সম্মুখীন হবে। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী বন্যার হটস্পটগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এছাড়া উপকূলে বসবাসকারী বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষ বন্যার মুখোমুখি হবে। বন্যার হটস্পট এর মধ্যে রয়েছে চীন, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও গুজরাট, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা, ভার্জিনিয়া এবং মেরিল্যান্ড, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপসহ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর জার্মানি। গবেষণায় বলা হয়, মানুষ যদি বেশি পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বালাতে থাকে এবং প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে তাহলে বিশ্বের আরও সাত কোটি ৭০ লাখ মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে। আগামী দিনগুলোতে বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে তা বিশ্বব্যাপ মোট দেশজ উৎপাদনের ২০ শতাংশ হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার যে দৃশ্য বিশ্ব দেখছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখনকার তুলনায় তা দশগুণ বেশি ঘন ঘন বন্যার কবলে পড়বে। বন্যায় বিশ্বের ২৫২ মিলিয়ন মানুষ এখন চরম ঝুঁকিতে আছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান জানান, জলবায়ুবিষয়ক বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের ৩০ লাখ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তীব্র বন্যার কবলে পড়বে দেশের নিম্নাঞ্চল। স্বন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি পরিমাপ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় চীন ও বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়ছে বলে নাসা সতর্ক করেছে। বাংলাদেশে উপরিভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের গড় উচ্চতা প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বাড়বে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<113197 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1