এবার চালের বাজারে অস্থিরতা

সব ধরনের চালের দাম কেজিতে গড়ে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সিন্ডিকেট ভাঙতে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
দোকানে রাখা চালের বস্তা -ফাইল ছবি
পেঁয়াজের পর এবার চালের মূল্যবৃদ্ধির চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে গড়ে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। মিলাররা বলছেন, বাজারে হঠাৎ ধানের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে চালের। আর খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। চালের কোনো ঘাটতি নেই। বোরো ও আউশের পর্যাপ্ত ধান ও চাল কৃষক ও ব্যবসায়ীপর্যায়ে রয়েছে। দেশে চাল উৎপাদন বেড়েছে। হঠাৎ চালের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বাজারসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে মিলমালিক সিন্ডিকেট। গেল সপ্তাহে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পরপরই একশ্রেণির ব্যবসায়ী সরবরাহ সংকটের অজুহাতে এর দাম ব্যাপক বাড়িয়ে দেয়। পরে সরকারের নানা পদক্ষেপে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে। এবার আমন চাল আসার আগে একইভাবে সংকটের কথা বলে একশ্রেণির ব্যবসায়ী চালের বাজার থেকে অতিমুনাফা লুটে নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান জোরদার করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে মোটা চাল গুটি ও স্বর্ণা ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের শুরুতেও এসব চালের কেজি ৪০ থেকে ৪২ টাকা ছিল। মাঝারি মানের লতা, পাইজাম ও ব্রি-২৮ খুচরায় ৪৮-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৫-৪৬ টাকায়। সরু সাধারণ মানের মিনিকেটের কেজি ৫৮-৬০ টাকায় ঠেকেছে, যা ছিল ৫২-৫৪ টাকা। যে মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল আগে ৫৫-৬০ টাকা কেজি ছিল, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। মিরপুর ১ নম্বরের চাঁদপুর স্টোরের স্বত্বাধিকারী আল-নাহিয়ান তুহিন যায়যায়দিনকে বলেন, চালের বাজার এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে। পাইকারি বাজারে বাড়তি দাম হওয়ায় তিনিও বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন। রাজধানীর গোপীবাগে খুচরা চাল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ ধরে চালের দাম বাড়তি। রশিদের মিনিকেট ২৫ কেজির বস্তা তিনি কিনেছেন এক হাজার ৪০০ টাকায়। কিছু দিন আগেও একই চাল তিনি এক হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, রশিদের চালের দাম বাড়লে অন্যরা দাম বাড়িয়ে দেন। গত কয়েকদিনে সবাই কেজিতে চালের দাম ৩-৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৫০ টাকার নিচে বাজারে এখন কোনো চাল নেই। তবে চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে নওগাঁ জেলা চালকল সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, গত জুলাইয়ের শেষের দিকে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়তে শুরু করেছিল। মাঝখানে সরকার চাল আমদানির পথ সুগম করলে এর প্রভাবে দাম কিছু দিনের জন্য স্থির ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ চাল আমদানি করেছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। সে কারণে দুই সপ্তাহ ধরে আবারও চাল ও ধানের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে বাজারে ধান প্রতি মণ ১১০০ থেকে ১১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান রফিকুল। একাধিক চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাম বেড়েছে তার মূল কারণ ছোট ছোট হাসকি মিলগুলো এখন চলছে না। সারা দেশে এক হাজারের মতো হাসকি মিল বন্ধ রয়েছে। শুধু বড় বড় অটো মিলে চাল উৎপাদন হচ্ছে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে চালের সরবরাহ কমে গেছে। যে কারণে বাড়ছে চালের দাম। তবে এ যুক্তির সঙ্গে একমত নয় বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, হাসকি মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে চালের দাম বাড়ছে, এটা সঠিক নয়। হাসকি মিল থেকে চাল খুব বেশি আসে না। চালের দাম বাড়ার কারণ মৌসুম শেষের দিকে চলে এসেছে। তাছাড়া এবার বছরজুড়েই প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে। এখনো প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। যে কারণে বাজারে ধানের সরবরাহ কম, দামও বেশি। ধানের দাম বেশি হলে চালের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা বৈরী আবহাওয়ায় ধান প্রক্রিয়াজাত করে চাল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা বলছেন। আমন মৌসুমের আগে চালের ঘাটতির অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও এখন বেশিরভাগ অটো রাইস মিলে চাল উৎপাদনে আবহাওয়ার কোনো প্রভাব নেই। এছাড়া বোরো ও আউশ ধানের বেশ সরবরাহ আছে। এ অবস্থায় দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ নেই। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চালের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। বোরো ও আউশ মৌসুমের পর্যাপ্ত ধান ও চাল কৃষক ও ব্যবসায়ীপর্যায়ে রয়েছে। এবার দেশে চাল উৎপাদন বেড়েছে। বাজারে ধান ও চালের ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ করে চালের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ার কোনো কারণ নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজার স্বাভাবিক রাখতে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দেড় লাখ টন চাল দেওয়া শুরু হয়েছে। খোলা বাজারে বিক্রি বাড়ানো হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে। সরকারের হাতে ১৪ লাখ ১৮ হাজার টনের বেশি চাল মজুত আছে। চালের কোথাও ঘাটতি নেই। এরপরও ঘাটতি হলে আমদানির অনুমতি আছে। চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। উলেস্নখ্য, এবার সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল আট লাখ টন ধান সংগ্রহের। এ পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার ৩৫ টন বা ২৭ দশমিক ১২ শতাংশ। সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন। এর মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ছয় লাখ ৫২ হাজার ১৮২ টন বা ৬৫ দশমিক ২১ শতাংশ। আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দেড় লাখ টন। সংগ্রহ হয়েছে ৯৬ হাজার ৪৭২ টন বা ৬৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।