পেঁয়াজে ভারতনির্ভরতা কমাতে গোয়েন্দা তাগিদ

প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমানোর সুপারিশ করেছে গোয়েন্দারা। পাশাপাশি আদা, চাল, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্য খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আরও ৬ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে গোয়েন্দারা এ প্রতিবেদনের কপি সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা সুপারিশে বলা হয়েছে, নিত্যপণ্যের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আগেই আমদামি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে আমদানি দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে। আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমানোর পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মনিটরিং বাড়ানোর পাশাপাশি মজুতদারি বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম জোরদার করাসহ টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয়কার্যক্রম ঢাকা মহানগরীসহ জেলা-উপজেলাপর্যায়েও সম্প্রসারণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাইকারি ও খুচরাপর্যায়ে দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের মনিটরিংয়ের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। যে অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার জন্য নজরদারি জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশে করোনাভাইরাস ও দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলে বন্যার কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পাইকারি ও খুচরা বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পেঁয়াজ ও আদার মূল্য বাড়ার পাশাপাশি চাল, ভোজ্যতেল, লবণ, ডাল, আলু, মুরগি, মাংস, রসুন ও কাঁচা মরিচসহ সব ধরনের সবজির বাজার মূল্য উর্ধ্বমুখী, যা করোনা মহামারির সময়ে প্রান্তিক ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছে। দেশে ডিসেম্বরে পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হয়। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে মুড়ি কাটা পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করে। ফলে পেঁয়াজের মৌসুম শুরুর ২-৩ মাস আগে ঘাটতি মেটাতে আমদানিনির্ভর হতে হয়। ভারত থেকে ৯৫ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। হঠাৎ করে চলতি মাসের ২য় সপ্তাহে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে দেশের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ করে দেয়। এক মাস আগেও দেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৪০ টাকা ও ভারতের পেঁয়াজ ২৫ থেকে ৩০ করে বিক্রি হলেও বর্তমানে দেশি ৮৫-৯০ ও ভারতের পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ভারতে থেকে পেঁয়াজ আমদানি পুনরায় শুরু হওয়ায় ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় দাম কমতে শুরু করেছে। পেঁয়াজ সংকটের বিষয়টি উলেস্নখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানি খরচসহ সময় কম লাগায় ভারত পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক বাজার। তবে শুধু ভারতের ওপর আমদানিনির্ভর না হয়ে মিসর, তুরস্ক, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারিভাবে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গত বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় এমনকি এলসিকৃত পেঁয়াজও রপ্তানি ছাড় না করায় দেশে পেঁয়াজের দাম রেকর্ড কেজি প্রতি ২শ থেকে ২শ ৫০ টাকা হয়েছিল। প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঈদুল আজহার পরপরই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে মোটা চাল ৩৭-৩৮ টাকার জায়গায় ৪৪-৪৫ টাকা এবং চিকন চাল ৫২-৬৩ টাকার জায়গায় ৫৪-৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ মোটা চাল কেজি প্রতি ৭-৮ ও চিকন চাল ২-৩ টাকা বেড়েছে। দেশে সারা বছরে শস্যের চাহিদা প্রায় ৩ কোটি মেট্রিক টন। এর মধ্যে গম, ভুট্টা ও অন্যান্য খাদ্যশস্যে রয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ২২ লক্ষ মেট্রিক টন। সে হিসাবে চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। তবে দফায় দফায় দেশে উত্তর মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বন্যা ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও বর্ষা মৌসুমে চালকলগুলোতে ধান শুকাতে না পারায় চাল উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার কারণে চালের বাজার কিছুটা বাড়ার যৌক্তিকতা থাকলেও বর্তমান বাজার দর অস্বাভাবিক। এতে প্রতীয়মান হয় অসাধু মিল মালিক, আড়তদার ও চালের পাইকারি বিক্রেতারা অধিক মুনাফা আসায় যোগসাজশে চালের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় এক মাসের ব্যবধানে বাজারে আদার দাম কেজি প্রতি ১শ টাকা বেড়েছে। বর্তমান বাজারে আদা আড়াইশ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আদার দাম বাড়ার পেছনে ভারতে মৃল্য বৃদ্ধি পাওয়া এবং দেশের চাহিদা অনুযায়ী অন্য দেশ থেকে আমদানি না করা অন্যতম কারণ। আলুর বাজারদরও চড়া বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বর্তমান আলু কেজি প্রতি ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আলু পচনশীল হওয়ায় এবং বন্যার কারণে সংরক্ষণ করতে না পারায় আলুর দাম বেড়ে যাওয়া অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সবজির বাজারও মানভেদে দাম বেড়েছে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচের দাম অস্বাভাবিক। দেড়শ টাকা দরে বিক্রি হওয়া কাঁচা মরিচ ও সবজির দাম বাড়ার জন্য বন্যাকে দায়ী করা হয়েছে। মসুর ডাল ও কম দামি ডালের বাজারও কেজি প্রতি ৫ টাকা করে বেড়েছে। ভোজ্যতেলের দাম লিটার প্রতি ১০ টাকা এবং পামওয়েলের দাম ২ টাকা হারে বেড়েছে। করোনার কারণে আমদানিনির্ভর দেশ ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে এর প্রভাব পড়েছে। এছাড়া ডিম, মাছ ও মাংসের দামও বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগিতে কেজি প্রতি ১০, খাসির মাংসে ৭০ থেকে ১শ, ডিম হালি প্রতি ৮ ও চিনির দাম ৩ টাকা করে বেড়েছে বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আমদানিকৃত পেঁয়াজের ৯৫ শতাংশ ভারত থেকে আনা হয়। সেখানে বন্যার কারণে পেঁয়াজের আবাদ নষ্ট হওয়ায় দেশে পেঁয়াজ কম আসতে শুরু করে। আগে আড়াইশ ডলারে প্রতি টন পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও এখন তারা ৭৫০ ডলারের নিচে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। বলা হয়, পেঁয়াজের মৌসুম ডিসেম্বরে। ২ থেকে ৩ মাস আগে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ভারত হঠাৎ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা স্টকে থাকা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেয়। সরকার টিসিবির মাধ্যমে কেজি প্রতি ৩৬ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করায় বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। করোনার কারণে পরিবহণ সমস্যা এবং বন্যার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ডিম-মাংস ও সবজির দাম বেড়েছে। পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বন্যা ও করোনাকে দায়ী করা হয়েছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আমিষের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডিম, মাছ ও মাংসের দাম বেড়েছে। কারণ চাহিদা অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ কম ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি 'অনেকটাই স্বাভাবিক' হয়ে আসায় বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করা উচিত বলে ওই প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে।