প্রশাসনিক দুর্নীতিতে বিব্রত সরকার

প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির ঘটনায় শুধু সরকারের অস্বস্তিই বাড়েনি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। খোদ সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের অনেকেই এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
করোনাকালীন দুর্যোগে স্বাস্থ্য খাতের নানা চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির রেশ না কাটতেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের খিচুড়িকান্ড এবং রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের তালা-বালতি কেনাসহ বেশ কয়েকটি পুকুরচুরির ঘটনায় দেশব্যাপী ফের সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার চরম অস্বস্তিতে পড়েছে। বিব্রতকর এ পরিস্থিতিতে সরকার প্রশাসনিক দুর্নীতি রোধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের শক্ত অবস্থানের কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে অনেকেই সংশয়ে রয়েছেন। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চরণ করে তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বন্ধে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জোরাল তাগিদ দিয়েছেন। দুর্নীতির কারণে সরকারের সব অর্জন নষ্ট হলে তা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না বলেও তিনি সর্বস্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের সতর্কবার্তা দেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠানে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার শপথ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নিজস্ব উদ্যোগেই 'শুদ্ধাচার' ও এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেন, সরকারপ্রধান এর আগেও একাধিকবার এ ধরনের হুঁশিয়ারি দিলে তাতেও যে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের টনক নড়েনি তা একের পর এক চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের ভাষ্য, স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য খিচুড়ি রান্নার কাজে প্রশিক্ষণ নিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ১৫ কোটি টাকার প্রকল্পের ফাঁদ এবং এ নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠার পর তা বাতিল করে দেওয়ার ঘটনায় প্রশাসনিক দুর্নীতির বিষবৃক্ষের শেকড় গভীরে পৌঁছে যাওয়ার চিত্র আরও দৃশ্যমান হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ৩০ থেকে ৩৩ গুণ বেশি দরে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের তালা-বালতি ও বাঁশিসহ বিভিন্ন মালপত্র কেনাকাটায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের পুকুরচুরির ঘটনায় সাধারণ মানুষের চোখ রীতিমতো কপালে উঠেছে। এছাড়া ফরিদপুর মেডিকেলে পর্দা ও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালগুলোর যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাত; এ নিয়ে গত কয়েক মাসে অন্তত অর্ধশত হাসপাতাল পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীকে আসামি করে দুদকের ১১ মামলা এবং জেকেজি-রিজেন্টকান্ডসহ আর্থিক অনিয়মের নানা ঘটনায় স্বাস্থ্য খাতও যে দুর্নীতির গভীর সাগরে নিমজ্জিত তা প্রকাশ পেয়েছে। ৪ জুন করোনা সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় দুই থেকে চার গুণ বেশি দাম নির্ধারণ ও নিম্নমানের সামগ্রী কেনার তথ্য সামনে উঠে এসেছে। এদিকে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির ঘটনায় শুধু সরকারের অস্বস্তিই বাড়েনি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। খোদ সরকারদলীয় রাজনীতিবিদরা অনেকেই এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা মনে করেন, সরকারের আমলা নির্ভরতার কারণে প্রশাসনিক দুর্নীতি লাগামছাড়া হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, সরকারের সদিচ্ছা ও 'জিরো টলারেন্সে'র কথা শোনা গেলেও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ \হকর্মকর্তাদের বড় শাস্তির তেমন দৃষ্টান্ত নেই। এ কারণে করোনার মতো মহাদুর্যোগের মধ্যেও তাদের দুর্নীতি থামেনি। যা ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে সরকারদলীয় শতাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে বহিষ্কার করা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পুকুরচুরির অভিযোগে একাধিক আমলাকে শুধু বদলি করা হয়। এতে পরোক্ষভাবে প্রশাসনিক দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। দলের একাধিক প্রবীণ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলা নির্ভরতা এতটাই বেড়েছে যে, খোদ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদরা এখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। করোনার সময় এ বিষয়টি সবার কাছে আরও স্পষ্ট হয়েছে। করোনা মোকাবিলার নীতিনির্ধারণী কাজে দলীয় নেতাদের মাইনাস করে আমলাদের গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির দায় এখন জনপ্রতিনিধিদের কাঁধে এসে চেপেছে। এসব নিয়ে অনেকের মধ্যে চরম অস্বস্তি ও অসন্তোষ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কেরানির দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধানই বলে দেয় সরকারের সেবা খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে। ভূমি-নদী-জলাশয় দখল, সরকারি ক্রয় খাতে দুর্নীতির প্রসার যে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে ঘটছে তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন তারা। আবার অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি আমলাতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। এর সমাধানসূত্র জবাবদিহি ও গণতন্ত্রের মধ্যে। কারণ দুর্নীতি ও জবাবদিহির মধ্যে একটা সুস্পষ্ট আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। প্রিন্সিপাল-এজেন্ট-ক্লায়েন্ট তত্ত্বে এজেন্ট ও ক্লায়েন্টের মধ্যে বোঝাপড়া ও যোগসাজশের ফলেই দুর্নীতির সূত্রপাত। যখন প্রিন্সিপাল তথা জনগণের কাছে এজেন্টকে (রাজনীতিক ও আমলা) কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। এখানে ক্লায়েন্ট হচ্ছে তারা, যারা সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স, পারমিট, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি পেতে চায় বা সরকারি অফিসে বিভিন্ন কাজের জন্য যাদের যেতে হয়। জবাবদিহি ও সুশাসন তথা গণতন্ত্র অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। কারণ একটা শুদ্ধ গণতান্ত্রিক পরিবেশেই রাজনীতিক বা আমলার সঙ্গে সরকারি অফিসে কাজের জন্য যাওয়া মানুষকে এই যোগসাজশ ঠেকানো সম্ভব। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সুযোগ নিয়ে আমলারা দুর্নীতির ফাঁদ পাতেন এবং মানুষ নিরুপায় হয়েই ঘুষ দেয়, ঘুষ দিতে হয়- যোগ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। রাজধানীর একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালের এক নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারি আমলাদের ঘুষ-দুর্নীতি এখন ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের সামাল দিয়ে কাজ করতে হলে ১৫ টাকার ইনজেকশনের সিরিঞ্জ কিনতে একশ টাকা বাজেট করতে হচ্ছে। এ কারণে নিষ্ঠাবান-সৎ কর্মকর্তারা অনেকে এসব দায়িত্ব থেকে সরে রয়েছেন। নির্বাহী ওই কর্মকর্তার দাবি, তার হাসপাতালের বেশ কয়েকটি প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ হওয়ার পরও শুধু দুর্নীতির দায় কাঁধে চাপার ভয়ে তিনি ওই কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেননি। কেননা এসব প্রকল্পের অর্থ ছাড় করানোর জন্য তার কাছে আমলারা মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করেছেন। যা পরিশোধ করা হলে তাকে ৫ টাকার পণ্য ১০ টাকায় কিনতে হবে। অথচ দ্বিগুণ দামে পণ্য কেনার জন্য ভবিষ্যতে অডিট আপত্তি উঠলে তাকেই দুর্নীতিবাজ সাব্যস্ত করা হবে। এদিকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, সম্প্রতি দেশের প্রশাসনিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। এর মধ্যে সেবা খাতের দুর্নীতি স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়েছে। এ খাতের দুর্নীতির কাছে সাধারণ মানুষ রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) এবং স্বাস্থ্য খাতে ঘুষ না দিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না। ফলে মানুষ তার সেবা পেতে বাধ্য হয়েই ঘুষ দিচ্ছে। এখন ঘুষ দেওয়া-নেওয়া সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। টিআইবির রিপোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজ বিশ্লেষকরা বলেন, 'ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না'- এ মানসিকতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফলে দুর্নীতিকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না। জনগণকে প্রদত্ত অঙ্গীকার সরকার যথাযথভাবে পালন না করায় সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী মানুষের ওপর ঘুষের বোঝা ও বঞ্চনা দিন দিন বাড়ছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে দুর্নীতি ও ঘুষের পরিমাণ কমে যাবে বলে অনেকের প্রত্যাশা থাকলেও গবেষণার ফল বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন কমেছে যার পেছনে বর্ধিত বেতন-ভাতাসহ অন্য কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যারা দুর্নীতি করে অভ্যস্ত তাদের জন্য বেতন-ভাতা কোনো বিষয় নয়। তারা বেতন-ভাতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করেন দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, বাংলাদেশ সরকারই শুধু নয়, ভারত সরকার, মার্কিন সরকারও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারছে না। কোনো সরকারই পারবে না। কেউই পারবে না। কিন্তু এটাকে কমিয়ে আনার জন্য আমাদের টপ লেভেলের কমিটমেন্ট দরকার। টপ লেভেলের কমিটমেন্ট এবং অন্য সব লেভেলের প্রচেষ্টা থাকলে এ ব্যাপারে ধীরে ধীরে উন্নতি হবে বলে আশা করেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ।