শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা-পরবর্তী শারীরিক জটিলতায় সংকটে রোগীরা

সুস্থ হয়েও অনেকে ভুগছেন শ্বাসকষ্ট ও নিদ্রাহীনতায় কোভিড-১৯ ফলোআপ ক্লিনিক মাত্র দুটি
জাহিদ হাসান
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

গত মার্চে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আবদুর রহমান। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হোম আইসোলেশন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে টানা ২১ দিন পর সুস্থ হন। তবে করোনাভাইরাস সারলেও তিনি হালকা কাঁশি ও শ্বাসকষ্টের মতো শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হওয়া করোনা-পরবর্তী অসুস্থতার চিকিৎসায় পোস্ট কোভিড-১৯ ফলোআপ ক্লিনিকে গেলে চিকিৎসক তাকে কিছু ওষুধ সেবন ও বুকের এক্স-রে পরীক্ষার পরামর্শ দেন। শুধু আবদুর রহমানই নন, করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির পর অনেকেই শ্বাসকষ্ট, নিদ্রাহীনতা ও অবসাদগ্রস্ততার মতো নানা জটিলতায় ভুগছেন। যাদের চিকিৎসায় রাজধানীর দুটি হাসপাতালে পোস্ট কোভিড-১৯ ফলোআপ ক্লিনিক খোলা হয়েছে; কিন্তু ঢাকার বাইরের রোগীদের জন্য এ সুবিধা না থাকায় অনেকেই বিড়ম্বনায় পড়ছেন। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত রোববার পর্যন্ত দেশে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬৫ মানুষ করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন। যাদের মধ্যে অনেকেই নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা স্বল্প-পরিসরে হলেও অন্তত দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পোস্ট কোভিড-১৯ ফলোআপ ক্লিনিক চলুর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়া একাধিক রোগী ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, এ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে মুক্ত হলেও বয়স্ক ও কো-মরবিডিটি সম্পন্ন (বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত) ব্যক্তিরা নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এক্ষেত্রে অনেকের মনোদৈহিক সমস্যায় ল্যাবরেটরি ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কাউন্সিলিংয়ের দরকার পড়ছে। অনেককে অতি-বিশেষায়িত সেবা যেমন- পালমোনলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, নিউরোলজি, সাইকিয়াট্রি, ফিজিক্যাল মেডিসিনসহ অন্যান্য বিভাগে সেবা প্রয়োজন হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে করোনা-পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভোগা রোগীদের সেবায় গত ২৯ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে পোস্ট কোভিড-১৯ ফলোআপ ক্লিনিক চালু হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক রোগী করোনা-পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতার সেবা নিতে ফলোআপ ক্লিনিকে ছুটে আসছেন। জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গকে আক্রমণ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। এমনকি মাঝারি ও তীব্র কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি (প্রায় পাঁচ বছর) ফলোআপের প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য যুক্তরাজ্য, চীন, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় পোস্ট কোভিড-১৯ ফলোআপ সেবা চালু করেছে। কারণ ফলোআপের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষণ ও প্রতিক্রিয়াগুলো চিহ্নিত করে বিপুলসংখ্যক রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি রোগের স্থায়িত্ব এবং মৃতু্যর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এসব বিবেচনায় বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বহির্বিভাগে পোস্ট কোভিড-১৯ ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। তবে ঢাকা মেডিকেল ও বিএসএমএমইউর ফলোআপ ক্লিনিকে আসা রোগীরা বলেন বিএসএমএমইউতে সপ্তাহে মাত্র দুদিন (শনি ও মঙ্গলবার) সকাল ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ফলোআপ চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাছাড়া ক্লিনিকটি শুধু প্রাইমারি কেয়ার সেন্টার হিসেবে কাজ করছে। একইভাবে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল-২ এর পঞ্চম তলায় চালু হওয়া পোস্ট কোভিড-১৯ ফলোআপ ক্লিনিকে আসা রোগীদের অভিযোগ প্রতি সপ্তাহের রবি ও বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৩ ঘণ্টা রোগী দেখা হয়। এতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পোস্ট কোভিড ফলোআপ এই ক্লিনিক চালু করা জরুরি হয়ে পড়ছে। বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও অনেকের শ্বাসকষ্ট, হার্টের সমস্যা, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, অবসাদগ্রস্ততা ও উদ্বিগ্নতাসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা নিয়ে পোস্ট কোভিড-১৯ ক্লিনিকে আসছেন। এখানে দৈনিক গড়ে ৩৫ জনের মতো রোগী সেবা নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ রোগী সেবা নিয়েছেন। রোগীদের শারীরিক পরিস্থিতি ও উপস্থিতি বিবেচনায় ক্লিনিকের কলেবর আরও বড়ানোর চিন্তা আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দীন যায়যায়দিনকে বলেন, করোনার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার পরও রোগীদের বড় একটা অংশ ক্রনিক ইলনেস অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট পুরোপুরি ভালো না হওয়ায় ফুসফুসে সংক্রমণ, স্মৃতিভ্রম বা মানসিক ট্রমা ও নিদ্রাহীনতা দেখা দিচ্ছে। যেসব সমস্যা নিয়ে রোগীরা আবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও সঠিক কারণ ব্যাখা করতে পারছেন না; কিন্তু সমস্যাগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত না হলে কো-মরবিডি সম্পন্ন রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা তৈরি হতে পারে। এজন্য করোনা-পরবর্তী উপসর্গের চিকিৎসার জন্য ঢামেকে পোস্ট কোভিড ফলোআপ ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। যেখানে দিনে ২৫ থেকে ৩০ জনের মতো রোগী আসছে। রোগীর সংখ্যা বাড়লে ক্লিনিকটিতে প্রতিদিন সেবা দেওয়াসহ প্রয়োজনে আরেকটি ক্লিনিক চালু করা হবে। তবে দেশের সব মেডিকেল কলেজে ফলোআপ ক্লিনিক চালু করলে রোগীদের ভোগান্তি কমবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে