শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নানা উদ্যোগেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না পেঁয়াজের দাম

আহমেদ তোফায়েল
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

সরকারি নানা উদ্যোগেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না পেঁয়াজের দাম। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। অবস্থা এমন যে, বাজার থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সব জায়গায় এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে পেঁয়াজ। গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০-১০০ টাকায়।

এদিকে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রোববার থেকে স্বল্পমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করলেও তার কোনো প্রভাব নেই বাজারে। কারণ তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম।

গত সোমবার ভারত হঠাৎ বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় রাতারাতি এ পণ্যটির দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। আতঙ্কে মঙ্গল ও বুধবার একশ্রেণির ক্রেতা বাড়তি পেঁয়াজ কিনে মজুত করেন। এতে রাজধানীর বাজারগুলোতে পেঁয়াজ কেনার এক ধরনের হিড়িক পড়ে যায়। দু'দিন বাড়তি কেনার পর বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ কেনার

পরিমাণ কিছুটা কমেছে। ফলে খুচরা বাজারে কমেছে পেঁয়াজ বিক্রি। তবে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া পেঁয়াজের দাম কমেনি।

সকালে রাজধানীর শান্তিনগর বাজারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রির ট্রাক ঘিরে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। ৩০ টাকা কেজি দরে একজন ক্রেতাকে দেওয়া হচ্ছে দুই কেজি করে পেঁয়াজ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সারাদেশে প্রতিদিন পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার টন। এই হিসেবে রাজধানীতেই চাহিদা প্রায় দেড় হাজার টন। সেক্ষেত্রে ঢাকায় ৪০টি ট্রাকের প্রতি ট্রাকে পেঁয়াজ মাত্র ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ কেজি বরাদ্দ রয়েছে। এই সামান্য পরিমাণ পেঁয়াজ দিয়ে কীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব- এ প্রশ্ন ভোক্তাদের।

খুচরা বিক্রেতারা বলেন, গত বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হয়েছিল। এ কারণে এবার ভারতের রপ্তানি বন্ধ এবং পেঁয়াজের দাম বাড়ার সংবাদে মঙ্গলবার পেঁয়াজ কেনার এক ধরনের হিড়িক পড়ে যায়। বুধবারও বাড়তি পেঁয়াজ কেনেন ক্রেতারা। মূলত গত দুদিনেই ভোক্তাদের বড় একটি অংশ পেঁয়াজ কিনে মজুত করেছে। এ কারণে পেঁয়াজের বিক্রি কমেছে।

তারা বলেন, পেঁয়াজের বিক্রি কমলেও পাইকারি বাজারে দাম কমেনি। যে কারণে খুচরা বাজারেও পেঁয়াজের দাম কমেনি। সহসা পেঁয়াজের দাম কমার সম্ভাবনাও কম। ভারত যদি বাংলাদেশকে পেঁয়াজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে দাম কিছুটা কমতে পারে। ভারত পেঁয়াজ না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা। আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা।

এদিকে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন এবং সুদের হার হ্রাস করার জন্য গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নিয়েছে। স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানিকৃত পেঁয়াজ খালাস করা হচ্ছে। পেঁয়াজ পরিবহণ নির্বিঘ্ন করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে পেঁয়াজের দামে লাগাম টানতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের অভিযান। অভিযানে এ পর্যন্ত ১৪৭টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় লাখ ৮৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ঢাকার শ্যামবাজার ও যাত্রাবাড়ী আড়ত, মালিবাগ বাজার এবং ঢাকার বাইরে বিভাগীয় কার্যালয়ের ৪৩টি টিম বিভিন্ন বাজারে তদারকি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ সময় পেঁয়াজ, আদা, আলু, চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি ও তদারকি করাসহ বিভিন্ন অপরাধে এ জরিমানা করা হয়। টিসিবির ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম তদারকি করা হয়।

এদিকে অভিনব কায়দায় পেঁয়াজের দাম নিয়ে প্রতারণা করছে কিছু অতিমুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী। কেজিপ্রতি পেঁয়াজের মূল্য তালিকায় ৮৫ টাকা লিখে বিক্রি করছে ৯২ থেকে ৯৫ টাকা। গতকাল রাজধানীর মিরপুর শাহ আলী এলাকায় এমন প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ অপরাধে চারটি পেঁয়াজের আড়তকে জরিমানা করা হয়েছে।

অভিযান পরিচালনা করেন অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মন্ডল ও ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রোজিনা সুলতানা।

এ প্রসঙ্গে আবদুল জব্বার মন্ডল জানান, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অভিযান চালানো হয়। এ সময় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে মূল্য তালিকার চেয়ে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা যায়। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো পেঁয়াজের মূল্য লিখে রেখেছে ৮২ থেকে ৮৫ টাকা। অথচ বিক্রি করছে ৯২ থেকে ৯৫ টাকায়। যা আইন অনুযায়ী দন্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধে চার প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- বিক্রমপুর বাণিজ্যালয় রাজু বাণিজ্যালয় চাঁদপুর বাণিজ্যালয় ও মজুমদার ট্রেডার্স। তিনি জানান, জরিমানার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। পরে এমন প্রতারণা করলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে পেঁয়াজের অস্থির বাজার স্বস্তিতে রাখতে পণ্যটির আমদানি ঋণপত্র খোলার (এলসি) ক্ষেত্রে মার্জিন বা নগদ জমার হার 'নূ্যনতম পর্যায়ে' রাখতে ব্যাংকগুলোকে গতকাল নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত ২ মার্চ জারি করা এক সার্কুলারে পেঁয়াজসহ কিছু ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে ঋণপত্র খোলার মার্জিন নূ্যনতম পর্যায়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার মেয়াদ ৩০ মে পর্যন্ত বলবৎ ছিল। বৃহস্পতিবারের সার্কুলারে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে নতুন নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হবে এবং ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবত থাকবে।

অন্যদিকে হুট করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধে উদ্বেগ জানিয়ে ফের তা চালু করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সরকার। পাশাপাশি পেঁয়াজ আমদানি বাড়িয়ে বাজার ঠান্ডা রাখতে বিদ্যমান ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন।

আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বুধবার বলেন, এ মুহূর্তে দেশে মজুত আছে সাড়ে পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ। আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ টন লাগবে। তাতে ঘাটতি থাকবে চার লাখ টনের মতো। গত কয়েকদিন ধরে অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার এক মাস সময় পেলে তুরস্ক, মিয়ানমার, চায়না থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারবে। তিনি পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের একমাস ধর্য ধরতে বলেছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজের ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে ভারত থেকে আমদানিতে সমস্যা হলে অন্যান্য দেশ থেকেও আমদানি করা হয়। সরকারি হিসেবে দেশে বর্তমানে ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়; কিন্তু পেঁয়াজ ঘরে তোলার সময় প্রায় পাঁচ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ বাজারে থাকে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি হয় ১১ লাখ টন; কিন্তু প্রতি বছর ৩০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ প্রয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112436 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1