শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাসিনোকান্ডে সুবিধাপ্রাপ্তরা অধরা

জব্দ করা টাকার মধ্যে ৩৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা
তানভীর হাসান
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

ক্যাসিনো বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হলেও এ অবৈধ কর্মকান্ড থেকে সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিরা এখনো অধরা। তাদের অনেকের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য আর্থিক খাতের গোয়েন্দাদের নজরে এলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি যুবলীগের বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোকান্ড থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অভিযোগ থাকলেও তাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।

এ বিষয়ে দায়েরকৃত ৩২ মামলার মধ্যে মানিলন্ডারিং ১৩ মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। এসব মামলায় ৭২ আসামির মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ৭টি মামলার। এর মধ্যে জব্দ করা ৩৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা পড়েছে। জব্দ করে রাখা হয়েছে ৪০৫ কোটি টাকা। তদন্তকালে আসামিদের বেশকিছু ফ্ল্যাট ও জমির সন্ধান পায় সংস্থাটি। এছাড়ার্ যাবের হাতে থাকা ১৪ মামলার মধ্যে ১৩ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। একটি মামলার তদন্ত স্থগিত রয়েছে। পুলিশের অন্য বিভাগও ৫টি মামলার তদন্ত শেষ করেছে। দুদকের পক্ষ থেকে ২২টি মামলা করা হয়।

জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, মানিলন্ডারিং ইসু্যতে সিআইডির হাতে যেসব মামলার তদন্তভার এসেছিল সে সবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তদন্তাধীন ৬টি মামলার মধ্যে পাঁচটির তদন্তই শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই এসব মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। একটি মামলার তদন্ত মাত্র শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, ক্যাসিনোকান্ডের পর অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয় নজরে এলে কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বাংলাদেশ ফাইন্যানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তাদের হিসাব মতে, কাজী আনিসুর রহমান এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ৯টি ব্যাংকে ৩৪টি হিসাব (ঋণ হিসাব ও ক্রেডিট কার্ডসহ) পরিচালিত হয়। এরমধ্যে ২১টি হিসাবের হিসাব খোলার ফরম ও লেনদেন বিবরণী, ২টি ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বিবরণী এবং ৩টি ব্যাংক গ্যারান্টির সংক্রান্ত দলিলাদি পাঠিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চলতি বছরের শুরুতেই সিআইডিতে পাঠিয়েছিল বিএফআইইউ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টদের তথ্য বলছে, ২০১৫ সাল পরবর্তী সময়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন আনিসুর। শান্তিনগরে পাঁচটি ফ্ল্যাট, ধানমন্ডি রায়ের বাজারে একটি বাড়ি, ল্যাবএইডের বিপরীতে ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কে ১৫ নম্বর ভবনে একটি ফ্ল্যাট, ৯/এ সড়কে ৫০ নম্বর বাড়িতে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। এছাড়া ধানমন্ডি ১০ নম্বর সড়কে ২২ নম্বর বাড়িতে আরেকটি (বি/১৩ নম্বর) ফ্ল্যাট আছে। এ ফ্ল্যাটে তিনি নিজেই বসবাস করতেন। স্বামীবাগে মিতালী স্কুলের গলিতে ৫৪ নম্বর বাড়িতে একটি, রামকৃষ্ণ মিশন রোড়ে ৭/২ হোল্ডিংয়ের বাড়িতে চারটি, একই সড়কে ৭/১/সি হোল্ডিংয়ের বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে আনিসুরের। এর বাহিরে গুলশান ১ নম্বরের

নাভানা টাওয়ারে তিনটি দোকান, উত্তরার রাজলক্ষ্ণী ও রাজউক মার্কেটে ২০টি দোকান রয়েছে তার। এছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকায় ১৭৫ বিঘা জমি, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ইউএনও অফিসের পাশে ও কলেজ মোড়ে দুটি বাড়ি। মুকসুদপুরে মা ফিলিং স্টেশন, নিজ গ্রাম বোয়ালিয়ায় ১৫০ একর জমি কিনেছেন আনিস। সেখানে মাছের ঘের ও হাঁসের খামার করা হয়েছে। নিজ গ্রামে তিন বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেছেন আলিশান প্রাসাদ।

এদিকে সিআইডি সূত্র জানায়, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি মামলার মধ্যে গুলশান থানার দুটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ৩৯ কোটি টাকা জব্দ দেখানো হয়েছে। ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার দেখানো হয়েছে। খালেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলাটির তদন্তকাজ এখনো চলছে। গুলশান থানায় করা একটি মামলায় জি কে শামীমসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এ মামলার চার্জশিটে এক কোটি ৮১ লাখ ২২ হাজার টাকা, নয় হাজার ইউএস ডলার এবং ৭৫২ সিঙ্গাপুর ডলার উদ্ধার দেখানো হয়েছে। ১৬ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকার এফডিআর এবং ৩২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া তিনটি মোটরসাইকেল ও ৫১ দশমিক ৮৩ কাঠা জমির সন্ধান পাওয়া গেছে।

গেন্ডারিয়া থানার একটি মামলায় এনামুল হক এনু এবং হারুনর রশিদসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় এনুসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি সদস্যরা অধরা। ওয়ারী থানায়ও দায়েরকৃত একটি মামলায় এনামুল হক এনুসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় এনুসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সূত্রাপুর থানায় দায়ের করা একটি মামলায় রূপম ভূঁইয়াসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৭ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনজন। সূত্রাপুর থানায় দায়ের করা অপর মামলার চার্জশিটে এনামুল হক এনুসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় ৮৮ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ১৬৪ ধারায় দুইজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

তদন্তাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ওয়ারী থানায় করা একটি মামলায় এনামুল হক এনু এবং রূপন ভূঁইয়ার ২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। গুলশান থানায় করা একটি মামলায় সেলিম প্রধানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ মামলায় ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ৭০ লাখ টাকার বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া ছয় কোটি টাকার দুটি চেক, নয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও থাইল্যান্ডে একটি বাগান বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। মতিঝিল থানায় দায়ের করা একটি মামলায় লোকমান হোসেনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। দুই কোটি ৯৮ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া একটি জিপ গাড়ি, একটি পস্নট ও একটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তারেকুজ্জামান রাজিবসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক কোটি ৪৬ লাখ ৭৭ হাজার ১৯২ টাকা জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া এ মামলায় একটি টয়োটা হার্ডজিপ, একটি ফ্ল্যাট ও দুটি পস্নটের সন্ধান পাওয়া গেছে। সবশেষে গত ১৩ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় ইসমাইল হোসেন সম্রাটের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে সিআইডি। এ মামলায় মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

১৩ মামলার চার্জশিট দিয়েছের্ যাব

র্

যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্(যাব) সহকারী পরিচালক সুজয় সরকার জানান, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের ঘটনায় ৩২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি মামলার দায়িত্বভারর্ যাবের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এসব মামলায় ১৩টিতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে একটি মামলার তদন্ত স্থগিত রয়েছে।র্ যাবের উপর যেসব মামলার তদন্তভার ন্যস্ত হয় সেগুলা হলো- অস্ত্র এবং মাদক সংক্রান্ত। আদালতের নির্দেশে যে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত আছে ফু-ওয়াং ক্লাবে অভিযান সংক্রান্ত। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মাদক সংক্রান্ত এ মামলাটি হয়েছিল। অস্ত্র ও মাদক মামলায়র্ যাব যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে তারা হলেন- যুবলীগের সাবেক নেতা- ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, জি কে শামীম, এনামুল হক আরমান, তারেকুজ্জামান রাজিব, অনলাইন ক্যাসিনোর অন্যতম হোতা সেলিম প্রধান এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ। তারা সবাইর্ যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112428 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1