বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা মোকাবিলা অর্ধশতাধিক কমিটি প্রায় বিলুপ্ত

জাহিদ হাসান
  ১৩ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

৮ মার্চ দেশে করোনা শনাক্তের পর এ মহামারি সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সরকারের অন্যান্য সংস্থা বা বিভাগের সঙ্গে কৌশল নির্ধারণ করতে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ে উচ্চ পর্যায়ে একটি কমিটি করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক হন ওই কমিটির সভাপতি। এর পরপরই চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নেওয়ার জন্য গঠিত হয় টেকনিক্যাল কমিটি। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এরকম ৪৩টি কমিটি গঠন করেছে। যার অধিকাংশ এখন প্রায় বিলুপ্ত। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে অভিযান এবং বদলির ফলে কোনো কমিটির কার্যক্রম আর অবশিষ্ট নেই। ফলে করোনা দ্বিতীয় ঢেউ আসলে তা কীভাবে মোকাবেলা করবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন,

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি থেকে শুরু করে প্রতিটি কমিটির ছিল নামকাওয়াস্তে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের অন্যান্য বিভাগ কখনোই কমিটির দ্বারস্থ হয়নি। মে মাসে গার্মেন্ট খোলা-বন্ধের খেলায় যখন দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়, খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমি কমিটির সভাপতি অথচ কোনো কিছুই আমাকে জানানো হয়নি। একই অভিযোগ অন্যান্য কমিটির সদস্যদেরও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের শেষদিকে চীনে প্রথম করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পর সেখানে বসবাসরত অসংখ্য বাংলাদেশি নাগরিক দেশে ফিরে আসেন। তারা ভাইরাস সংক্রমিত কিনা? পজিটিভ হলে চিকিৎসা কি? সে জন্য চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের নিয়ে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় গত ৬ মাসে স্বয়ং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটিসহ বিশেষজ্ঞদের দুটি কমিটি, জাতীয় পরিকল্পনার ১৩টি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর ২৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও ১০টি নতুন কমিটি করে। এর মধ্যে করোনা তথা কোভিড-১৯ কোর কমিটিগুলোর সমন্বয় কমিটি, জোনিং সিস্টেমবিষয়ক গ্রম্নপ, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ, মান ও মূল্য নির্ধারণ এবং তদারকি কমিটি, তথ্য ব্যবস্থাপনা, গণসংযোগ ও কমিউনিটি মবিলাইজেশন কমিটি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কমিটি, অত্যাবশ্যকীয় ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কমিটি, কোভিড-১৯ ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সক্ষমতা বৃদ্ধিবিষয়ক কমিটি, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও পরিবেশ সংক্রমণ এবং নিয়ন্ত্রণ কমিটি, ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটিসহ করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অন্তত অর্ধ শতাধিক কমিটি করা হয়। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রায় সব রাজনৈতিক দল করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন কমিটি গঠন করে।

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা যায়যায়দিনকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব রোধে বিভিন্ন সময় পরামর্শক কমিটি করা হলেও তাদের মতামতের প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। কিছু কমিটিতে বিশিষ্টজনদেরকে তাদের সম্মতি ছাড়াই সদস্য করা হয়। আবার কমিটি বিলুপ্ত হলেও সদস্যদের তা জানানো হয়নি। কোনো কোনো ব্যক্তির নাম চার-পাঁচটি কমিটিতেও দেখা গেছে। ফলে একটা পর্যায়ে এসে এত কমিটির কাজ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার এতকিছু করেও করোনা পরিস্থিতি অনুধাবন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত দরকার, জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকরা তা পাচ্ছেন না। নমুনা সংগ্রহ ও রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা সন্তোষজনক হচ্ছে না। অথচ কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য করোনা মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেও শুরু থেকে যেভাবে ও যে ধরনের কমিটি হয়েছে বা এখনো হচ্ছে তাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। কারণ কমিটি অনেক বিষয়ে পরামর্শ দিলেও সেসব ব্যাপারে কর্ণপাত করা হয়নি। বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্যখাত নিয়ে নানা মুনির নানা মতে দিশেহারা স্বাস্থ্যখাত গত ৬ মাসেও সংক্রমণের লাগাম টানতে পারেনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের উপদেষ্টা মোজাহেরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ নামক আইন রয়েছে। যেটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মহামারি করোনাভাইরাস তথা সব ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ফলে কমিটি গঠনের কোনো দরকার ছিল না। বরং কীভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে একটি কৌশল ঠিক করা উচিত ছিল।

এর আগে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়তা দিতে চীনের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সফরে এসে সংক্রমণ মোকাবিলায় নানা ক্ষেত্রে ঘাটতির কথা জানান। চীনা প্রতিনিধিরা বলেন, করোনার সংক্রমণ বন্ধে নজর নেই বাংলাদেশের। বরং কর্মকর্তা ও চিকিৎসা পেশাজীবীরা রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের চেয়ে চিকিৎসার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ও সম্পদ বরাদ্দ, জনবল বদলি-নিয়োগে সমন্বয়ের ঘাটতির কথা বলেন। ফলে দ্রম্নত রোগ শনাক্ত, দ্রম্নত রিপোর্ট প্রদানসহ দ্রম্নত আইসোলেশন ও চিকিৎসা নীতি গ্রহণের মাধমে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের প্রচারের পরামর্শ দেন। দুর্বলতা শনাক্তের পাশাপাশি প্রতিনিধি দল ৬টি সুপারিশও করেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরাও করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে শুরু থেকেই করোনো উপসর্গযুক্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরকে আইসোলেশন, আক্রান্তদেরকে কোয়ারেন্টিন, তাদের সংস্পর্শে মানুষদের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করতে নির্দেশনা দেন। সংক্রমণ প্রাদুর্ভাব কমাতে নির্ধারিত এলাকায় লকডাউনের পর্যায় নির্ধারণে অঞ্চলভিত্তিক সংক্রমণ হার দেখে লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা চিহ্নিত করার পরামর্শ দেন। এ ধারাবাহিকতায় জাতীয় ও কারিগরি বা টেকনিক্যাল কমিটিসহ একাধিক কমিটির পরামর্শে কিছুটা ঢিলেঢালাভাবে তা বাস্তবায়ন হলেও আদতে কিছুই হয়নি। এর মধ্যে স্বাস্থ্যখাত জড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি সামনে চলে আসে। এমনকি ন্যাশনাল অ্যাডভাইজারি কমিটি ও জাতীয় কারিগরি কমিটির নিয়মিত সভা বা তারা বিশেষ কী পরামর্শ দিয়েছেন সরকার তাও জানাতে পারেনি।

বিশিষ্ট ভাইরারোলজিস্ট ডা. বে-নজির আহম্মেদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পরামর্শগুলো দিয়েছেন সেই নির্দেশনার আলোকে রাষ্ট্র কীভাবে, কতদিনের মধ্যে, কি পদ্ধতিতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করবে সে সংক্রান্ত একটি কৌশল নির্ধারণ করার দরকার ছিল। যেটি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যবিভাগের মহাপরিচালককে ওই আইনের সাহায্য নিতে পারতেন। এ জন্য কমিটি গঠনের প্রয়োজন ছিল না।

ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর নেতা বলেন, শুরুতে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া এবং দায়বদ্ধ করার বিষয়টি ছিল না। যেহেতু এটা দেশব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা সেহেতু এটির দায়িত্বে পালন করবেন প্রতি জেলা সিভিল সার্জনরা। তারা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে বাস্তবায়ন করবেন। ব্যর্থ হলে স্বাস্থ্যের ও ডিজির কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার যথার্থ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে যেসব কমিটি হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি।

প্রসঙ্গত বর্তমানে করোনা শনাক্তে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে ৭ হাজার ৫০৯ জনের করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়া ওয়ার্ল্ডো মিটারসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুই লক্ষাধিক আক্রান্ত আছে এমন দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে কেবল আফগানিস্তানে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ মেয়াদি বৃহত্তর সংক্রমণের দিকে যাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108660 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1