মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক সেনা কর্মকর্তার হত্যাকান্ড নিয়ে তোলপাড়

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শুরু পরিবারের দাবি স্পষ্টতই হত্যা সামরিক মর্যাদায় দাফন
তানভীর হাসান, ঢাকা ও জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
  ০৫ আগস্ট ২০২০, ০০:০০
সিনহা মো. রাশেদ খান

কক্সবাজার টেকনাফের শাপলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান মৃতু্যর ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। নিহতের মায়ের দাবি স্পষ্টতই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে পুলিশের ভাষ্য, চেকপোস্টে তলস্নাশির এক পর্যায়ে সিনহা পিস্তল বের করার চেষ্টা করলে তারা গুলি করতে বাধ্য হন। এমন পরিস্থিতিতে গত কয়েকদিনে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ২০ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল থেকে কাজ শুরু করেছে।

গত ৩১ জুলাই রাত ৯টায় টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শাপলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এই ঘটনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মেজর (অব.) সিনহার বুকে গুলি ছোড়েন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী।' অন্যদিকে টেকনাফ মডেল থানায় পুলিশের করা মামলায় উলেস্নখ করা হয়েছে, 'সিনহা মো. রাশেদ হঠাৎ করে তার কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করার চেষ্টা করলে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী জানমাল রক্ষার জন্য চারটি গুলি করেন।' এতে সিনহার মৃতু্য হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা দায়ের করেছে। গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সিনহার সঙ্গী সিফাতসহ আরও এক যুবককে। ময়নাতদন্ত শেষে সিনহা রাশেদকে সোমবার ঢাকায় সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। নিহত সিনহার গ্রামের বাড়ি যশোরের বীর হেমায়েত সড়কে। তার বাবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এরশাদ খান। সিনহা ৫১ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন। ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করেন।

জানা গেছে, সিনহা নিহতের পর প্রথমে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাহজাহান আলিকে প্রধান করে তিন সদস্যদের কমিটি গঠন করা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার জন্ম দিলে পরে তা পুনর্গঠন করা হয়েছে। নতুন কমিটির প্রধান করা হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। এছাড়া কমিটিতে রাখা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি (জিওসি, ১০ পদাতিক ডিভিশন ও এরিয়া কমান্ডার, কক্সবাজার এরিয়া কর্তৃক মনোনীত), উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক চট্টগ্রাম রেঞ্জের প্রতিনিধি ও মোহাম্মদ শাজাহান আলী অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কক্সবাজারকে। কমিটিকে সরেজমিনে তদন্ত করে ঘটনার কারণ, উৎস অনুসন্ধান এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, তার করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত দিতে বলা হয়েছে। এরপর গত ২ আগস্ট কক্সবাজারে আসেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক ও অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. জাকির হোসেন। তারা সোমবার বিকালে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফ পরিদর্শন করলেও গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেন। তবে গতকাল কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দুঃখজনক। একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত করা হবে। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সার্বিক বিষয়ে গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টা নিয়ে যেহেতু তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, গত ৩১ জুলাই রাতে চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সিনহার মৃতু্যর পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা সবার সাথে কথা বলেন। এরপর একটি প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেন।

সেখানে সিনহার মৃতু্যর বিষয়ে বলা হয়, ৩ জুলাই ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসেন মেজর (অব.) সিনহা। তিনি 'জাস্ট গো' নামে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও নির্মাণ করছিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের সিফাতসহ আরও ২ জন। তারা মেরিন ড্রাইভ সড়কের হিমছড়ি ঝরনা এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ওঠেন। এরপর থেকে তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং করতে থাকেন। সব শেষে গত ৩১ জুলাই বিকেলে সিফাতকে নিয়ে মেজর (অব.) সিনহা কক্সবাজার থেকে টেকনাফের শাপলাপুর পাহাড়ে যান। এ সময় সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার পরনে ছিল সামরিক পোশাক (কম্ব্যাট টি-শার্ট, কম্ব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট)। রাত সাড়ে আটটার দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় স্থানীয় কয়েকজন লোক ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার দেন এবং শাপলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেন। এমন পরিস্থিতিতে সিফাতকে নিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে ওঠেন সিনহা। বিজিবির একটি চেকপোস্টও তারা পার করেন। এরপর রাত ৯টার দিকে তারা পৌঁছান শাপলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। সেখানে আগে থেকেই ডাকাত প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের সদস্যরা। পুলিশের সংকেত পেয়ে মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থামান এবং নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে তাদের চলে যাওয়ার সংকেত দেওয়া হয়। পরে পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাদের পুনরায় থামান এবং তাদের দিকে পিস্তল তাক করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ান। মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলি করার পরপরই রাত পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় জনগণ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠকর্মী সার্জন আইয়ুব আলী। তখন গুলিবিদ্ধ সেনা কর্মকর্তাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান তারা। সার্জন আলী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে পুলিশ সার্জনের পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশ সার্জনের হাত থেকে মুঠোফোন সেট ও তার পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়। এরপর রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আনা হয় একটি মিনিট্রাক। ট্রাকে ওঠানোর সময়ও মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন এবং নড়াচড়া করছিলেন। এরপর সিনহাকে নিয়ে ট্রাকটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর। তখন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব ১ ঘণ্টার পথ। অতিরিক্ত ৪৫ মিনিট অতিবাহিত করা পুলিশের একটি অপকৌশল বলে প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়। সিনহার অবস্থানগত রিপোর্ট থেকে মদ ও গাঁজা পাওয়ার বিষয়টি সত্য বলে উলেস্নখ্য করা হয়। সে এগুলো সেবন করে বলেও সিনহার সঙ্গীরা স্বীকার করেছে। বলা হয় চেকপোস্টে হয়তো সিনহা রুঢ় আচরণ করতে পারেন। তবে গুলি বর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকতও মাদকাসক্ত থাকতে পারেন। এ কারণে লিয়াকতের ডোপটেস্ট করানো জরুরি। পাশাপাশি সিনহার সাথে থাকা সিফাতের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কার কথা জানানো হয়। কারণ এ ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সিফাত। তাকেও অস্ত্র উদ্ধারের নামে হত্যা করার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে পুলিশের দাবি, চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তলস্নাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গাড়ি থেকে ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়। পরে সিনহা যে গেস্ট হাউসে উঠেছিলেন সেখান থেকেও বিদেশি মদ ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন জানান, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত বলে সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেন। এই সময়ে তলস্নাশি চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তার পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করেন। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অনেক সময় ডাকাতরা সামরিক পোশাকেও চলাফেরা করে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত এক বছরে মেরিন ড্রাইভে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ২০০ লোক মারা গেছেন। ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ওর্ যাবের সঙ্গে একাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ১৭৪ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬২ জন ওর্ যাবের সঙ্গে ৫১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন। পুলিশের দাবি, নিহত লোকজনের অধিকাংশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী।

সিনহাকে স্পষ্টতই হত্যা করা হয়েছে, দাবি পরিবারের

এদিকে নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার দাবি করেন, ??'এটা স্পষ্ট একটা হত্যাকান্ড। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা তো ভাইকে আর বাস্তবে পাব না। আমরা চাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। যারা জড়িত, তাদের বিচার হোক।' রোববার একটি সংবাদ মাধ্যমকে তিনি এ অভিযোগ করেন।

শারমিন বলেন, সিনহা অত্যন্ত মেধাবী এবং অন্য রকম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসে পড়তেন। পরিচিতজনেরা তাকে সমস্যার সমাধানকারী হিসেবে চিনত। বিশ্বভ্রমণের প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল সিনহার। সেই চিন্তা থেকেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। চাকরি ছাড়ার পর গত দেড় বছরে ভ্রমণ পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ?'ব্যাকপ্যাকটিও' ছিল রেডি। এ বছরই চীন যাত্রার মধ্য দিয়ে সেই ভ্রমণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সবকিছু থেমে যায়। সিনহার পরিকল্পনা ছিল বিশ্ব ভ্রমণের খুটিনাটি তিনি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দেবেন। করোনার কারণে যেহেতু ভ্রমণ শুরু করা গেল না, তাই বসে না থেকে কক্সবাজারকেন্দ্রিক প্রামাণ্য চিত্র বানানোর জন্য সিনহা চলে যান। সর্বশেষ ২৬ জুলাই ভাইয়ের জন্মদিনে শারমিন কক্সবাজারে কেক পাঠিয়েছিলেন। ঘটনার আগের দিনও মায়ের সঙ্গে তার স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়েছে।

শারমিন বলেন, তার বাবা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। তার ভাইও দেশের জন্য কাজ করেছেন। তাকে এভাবে মারা যেতে হবে, তা তারা কখনোই ভাবেননি। এটা মেনে নেওয়া যায় না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<107749 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1