গণমানুষের নায়ক মান্না

১৭তম মৃতু্যবার্ষিকী আজ

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
নব্বই দশকের বাংলা সিনেমার দর্শকপ্রিয় চিত্রনায়ক মান্না। সে সময়ে ঢালিউডে একতরফা রাজত্ব করেছিলেন তিনি। দর্শকদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমা। বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে যে কজন চিত্রনায়ক সাধারণ মানুষের কাছে এখনো জনপ্রিয় তাদের মধ্যে মান্না অন্যতম। অভিনয় দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নায়ক। জনপ্রিয় এই চিত্রনায়ক আমাদের মাঝে নেই। আজ তার চলে যাওয়ার দিন। চিত্রনায়ক এস এম আসলাম তালুকদার মান্নার ১৭তম মৃতু্যবার্ষিকী আজ। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রম্নয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মান্না মৃতু্যবরণ করেন। তার মৃতু্যর খবর শুনে বিএফডিসির আঙিনা থেকে শুরু করে সামনের রাস্তা; গোটা এলাকা যেন জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছিল। সবার চোখের কোণে ছিল জল, বুকে হাহাকার। মানুষের কাছে তিনি কতটা প্রিয় ছিলেন, সেটার বিরল নজির দেখা গিয়েছিল সেই দিন। মৃতু্যর পর টাঙ্গাইলে তার নিজ গ্রাম এলেঙ্গায় তাকে সমাহিত করা হয়। মৃতু্যর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। মান্না একাধারে নায়ক, প্রযোজক ও সংগঠক ছিলেন। অনেক গুণী জ্যেষ্ঠ অভিনয় শিল্পীকে তিনি চলচ্চিত্রে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির খারাপ সময়ে একাই হাল ধরে বহু হিট, সুপার হিট সিনেমা উপহার দিয়েছিলেন মান্না। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পরই ১৯৮৪ সালে তিনি নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। এরপর থেকে একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নিজেকে সেরা নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলেন। সমগ্র চলচ্চিত্র জীবনে তিনি মোট তিন শতাধিক সিনেমায় কাজ করেছেন। ঢাকাই সিনেমার অ্যাকশনখ্যাত মান্নার প্রথম অভিনীত সিনেমা 'তওবা'। কিন্তু প্রথম মুক্তি পায় 'পাগলী' সিনেমাটি। ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত 'কাসেম মালার প্রেম' সিনেমায় প্রথম একক নায়ক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন। এর আগে সব সিনেমায় মান্না দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন। 'কাসেম মালার প্রেম' সিনেমাটি দর্শকের মাঝে সাড়া ফেলার কারণে মান্না একের পর এক একক সিনেমায় কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। এরপর কাজী হায়াৎ পরিচালিত 'দাঙ্গা' ও 'ত্রাস' সিনেমার কারণে তার একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। মোস্তফা আনোয়ার-এর 'অন্ধ প্রেম', মনতাজুর রহমান আকবরের 'প্রেম দিওয়ানা', 'ডিস্কো ড্যান্সার', কাজী হায়াতের 'দেশদ্রোহী', আকবরের 'বাবার আদেশ' সিনেমাগুলো মান্নার অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পায় 'শান্ত কেন মাস্তান' ও ১৯৯৯ সালে আকবরের 'কে আমার বাবা', কাজী হায়াতের 'আম্মাজান', রায়হান মুজিব ও আজিজ আহমেদ বাবুলের 'খবর আছে', মালেক আফসারী পরিচালিত এবং তার প্রযোজিত দ্বিতীয় সিনেমা 'লাল বাদশা'র মতো সুপারহিট সিনেমা উপহার দেন মান্না। তার সিনেমা মানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি দর্শক এবং প্রযোজকের পকেটে লাভের টাকা। তার সিনেমায় বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কথা উঠে এসেছে বারবার। বঞ্চিত মানুষের কথা সিনেমার পর্দায় সুনিপুণভাবে তুলে ধরে তিনি সবার মন জয় করেন। তাই তিনি ছিলেন আপামর জনসাধারণের প্রিয় নায়ক। মান্না শুধু চলচ্চিত্র অভিনেতাই ছিলেন না, তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে যতগুলো সিনেমা প্রযোজনা করেছেন, প্রতিটি সিনেমা ব্যবসাসফল হয়েছিল। সিনেমাগুলো হচ্ছে 'লুটতরাজ', 'লাল বাদশা', 'আমি জেল থেকে বলছি', 'স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ', 'দুই বধূ এক স্বামী', 'মনের সাথে যুদ্ধ', 'মান্না ভাই' ও 'পিতা মাতার আমানত'। মান্না তার জীবদ্দশায় অনেক সুপারহিট চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। তার অভিনীত উলেস্নখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে 'সিপাহী', 'যন্ত্রণা', 'অমর', 'পাগলী', 'ত্রাস', 'লাল বাদশা', 'আম্মাজান', 'আব্বাজান', 'রুটি', 'অন্ধ আইন', 'স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ', 'অবুঝ শিশু', 'মায়ের মর্যাদা', 'মা-বাবার স্বপ্ন', 'হৃদয় থেকে পাওয়া' প্রমুখ। মান্না স্রেফ একজন নায়ক ছিলেন না, বলা হয় ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন তিনি। সিনেমা জগৎটাকে তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছেন, তা অকপটে বলেও গেছেন। তার সেসব কথা এত বছর পেরিয়ে এখনো সবার কানে বাজে, ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলে গেছেন মান্না। যেটা এখনো শোবিজের মানুষকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। কথাটি ছিল এরকম, 'পৃথিবীর কোনো জগৎ যদি থাকে, চলচ্চিত্র জগৎ; এর মতো স্বার্থপর কোনো জগৎ আর নেই। এখানে আমরা সবাই বাণিজ্যিক। হৃদয়, প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, চাওয়া-পাওয়া সব মেকি। সিনেমা পরিবারের কেউ যদি বুকে হাত দিয়ে বলে, আমরা সবাই এক পরিবার; না, মিথ্যে। সবাই আলাদা।' মান্নার বলে যাওয়া কথাটি কতটা সত্য, তা গত কয়েক বছরের অবস্থা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। কেবল একটি সংগঠনের চেয়ার দখল নিয়ে যে কাদা ছোড়াছুড়ির সাক্ষী হয়েছে ঢালিউড, তাতে গোটা দেশের কাছেই ইন্ডাস্ট্রির ভেতরকার চিত্র স্পষ্ট হয়ে গেছে। উলেস্নখ্য, মান্নার আসল নাম সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার। ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। অভিনেতা হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, তিনবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, পাঁচবার বাচসাস পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন মান্না।