দীর্ঘ এক বছর পর শুক্রবার রাতে ঢাকার মঞ্চে গাইতে ওঠেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। সোয়া এক ঘণ্টা গাইলেনও। আমন্ত্রিত দর্শক-শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তার গান। এমন সময় হঠাৎ মঞ্চে অসুস্থ হয়ে পড়েন সাবিনা ইয়াসমিন। গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই লুটিয়ে পড়লেন এই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী। দ্রম্নত তাকে গুলশানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এখন তিনি চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে আছেন বলে জানিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিনের মেয়ে ইয়াসমিন ফায়রুজ বাঁধন। সাবিনা ইয়াসমিনের শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে গণমাধ্যমকে বাঁধন বলেন, 'মা এখন ভালো আছেন। হাসপাতালে ডাক্তারদের অবজারভেশনে আছেন। বিকালে চিকিৎসকদের একটি মিটিং আছে। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে।'
এইচএসবিসি আয়োজিত 'আমাদের সাবিনা ইয়াসমীন : আমি আছি থাকব' অনুষ্ঠান দিয়ে দীর্ঘদিন পর মঞ্চে ফেরেন সাবিনা ইয়াসমিন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী জাহাঙ্গীর সাঈদ। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, 'সাবিনা আপার ভার্টিগো সমস্যা রয়েছে। হঠাৎ গাইতে গাইতে তিনি ভার্টিগো সমস্যায় পড়েন। এরপর মাইক্রোফোন স্ট্যান্ড ধরতে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে পারেননি, পড়ে যান। তারপর দ্রম্নত হাসপাতালে নেওয়া হয়।'
এক বছরের বেশি সময় ধরে গানের মঞ্চের বাইরে গুণী এ শিল্পী। এই দীর্ঘ সময়ে গায়িকা ব্যস্ত থেকেছেন বিদেশ বিভুঁইয়ে রোগব্যাধি ও চিকিৎসার সঙ্গে। কারণ শরীরে ক্যানসার ফিরেছিল তার। প্রথম দফায় ২০০৭ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এই সঙ্গীতশিল্পী। পরে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে এবং গানেও ফিরেছিলেন। মাঝের বছরগুলোয় কেবল দেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্টেজ শো করেছেন।
গত বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে ফের সাবিনার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে। দেশের পাশাপাশি ভারতীয় গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছিল এই খবর। পরে দেশবাসীর উদ্দেশে এক বার্তায় সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন সাবিনা। তিনি বলেছিলেন, গত ৭ ফেব্রম্নয়ারি তার দাঁতে ছোট একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তারপর পুরোপুরি সুস্থ হতে তাকে অনেকগুলো রেডিওথেরাপি নিতে হয়েছে।
কিছুদিন আগে সাবিনা ফিরে এসেছেন ঢাকায়। এর মধ্যে ৪ জানুয়ারি ঢাকাই সিনেমার অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমানের মরদেহ চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে নেওয়া হলে, সেখানে এসেছিলেন সাবিনা। ছোটবেলার বান্ধবী অঞ্জনাকে নিয়ে পুরনো স্মৃতি সেদিন সাবিনা তুলে ধরেন সংবাদকর্মীদের সামনে।
সাবিনা ইয়াসমিন এক পারিবারিক সুরের আবহাওয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা লুৎফর রহমান সরকারি চাকরি করলেও চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। মা মৌলুদা খাতুন মুর্শিদাবাদের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ কাদের বক্সের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। সাবিনা ইয়াসমিন ওস্তাদ পিসি গোমেজের কাছে একটানা ১০ বছর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। তবে মঞ্চে গান গাইতে ওঠেছেন মাত্র ৭ বছর বয়সে।
১৯৬২ সালে 'নতুন সুর' চলচ্চিত্রে শিশু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে রবীন ঘোষের সুরে একটি গান গেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। ১৯৬৪ সালে তিনি বেতারে ছোটদের গানের অনুষ্ঠান 'খেলাঘর'-এ নিয়মিত অংশ নিতেন। ১৯৬৭ সালে 'আগুন নিয়ে খেলা' ছবিতে পেস্ন-ব্যাক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে সাবিনা ইয়াসমিনের। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গানের সংখ্যা কয়েক হাজার। পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ১৪ বার। আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড ২০১৮-এ আজীবন সম্মাননা পান সাবিনা ইয়াসমিন। তার প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে এইচএমভির ডবল পস্নাটিনাম ডিস্ক, উত্তম কুমার পুরস্কার, বিশ্ব উন্নয়ন সংস্থা থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা।
সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের মধ্যে 'শুধু গান গেয়ে পরিচয়', 'জন্ম থেকে জ্বলছি মা গো', 'আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই', 'চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও', 'অশ্রম্ন দিয়ে লেখা এ গান', 'দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা', 'এ সুখের নেই কোনো সীমানা', 'বরষার প্রথম দিনে' ও 'আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা' উলেস্নখযোগ্য।
তার দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে 'জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো', 'সব ক'টা জানালা খুলে দাও না', 'ও আমার বাংলা মা', 'মাঝি নাও ছাড়িয়া দে', 'সুন্দর সুবর্ণ' ও 'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতা' উলেস্নখযোগ্য। ভারতের বরেণ্য সুরকার আরডি বর্মণের সুরে গান করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। কিশোর কুমার ও মান্না দে'র সঙ্গে দ্বৈতগানেও কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।