জন্মদিনে স্মরণ

খ্যাতিমান নির্মাতা তারেক মাসুদ

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
চলচ্চিত্রে আধুনিক ভাষা ও সমকালীন বিষয়াবলি জোরালোভাবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে বিকল্পধারার অন্যতম প্রবাদপুরুষ। চলচ্চিত্র ছিল তার মন ও মননে। আমেরিকায় বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থেকে স্ট্রাগলের পথ বেছে নিয়েছিলেন এই সিনেমাযোদ্ধা। নিজের বানানো ছবিকে তিনি দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে কাদা মাটি জল ডিঙিয়ে হেঁটে গেছেন বহুদূর। ফেরিওয়ালার মতো সিনেমার মাধ্যমে নানারকম বার্তা ফেরি করে গেছেন তিনি আমৃতু্য। তিনি প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। আজ তার জন্মদিন। খ্যাতিমান নির্মাতা তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ ও বাবা মশিউর রহমান মাসুদ। ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসায় প্রথম পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে মাওলানা পাস করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের পর তিনি সাধারণ শিক্ষার জগতে প্রবেশ করেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তিনি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ছয় মাস পড়াশোনার পর বদলি হয়ে নটর ডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেন। শিক্ষা জীবন থেকেই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তাকে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকাররা নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। তার প্রমাণ মিলে তারেকের নির্মিত ছবিতে, তার চলচ্চিত্রের দর্শন ও নির্মাণে। তারেক মাসুদ একাধারে ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং চিত্রনাট্যকার। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি। ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে 'আদম সুরত' শিরোনামের তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তারেক। শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে আহমদ ছফা রচিত একটি লেখা তারেক মাসুদকে এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে অণুপ্রাণিত করে। এরপর টানা সাত বছর ধরে শিল্পীর সান্নিধ্যে থেকে এ তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় ধারণকৃত ৫৪ মিনিটের এ তথ্যচিত্রটি দর্শকমহলে যথেষ্ট সমাদৃত হয়। তবে তারেক মাসুদ বরেণ্য হয়ে আছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর দুটি তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য। সেগুলো হলো 'মুক্তির গান' ও 'মুক্তির কথা'। যুদ্ধের সময় এ দেশে আসেন মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন। 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা' নামের একটি দলের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করার দৃশ্যগুলোকে ক্যামারায় ধারণ করেন তিনি। কিন্তু আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ করতে পারেননি। ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ নিয়ে পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয় 'মুক্তির গান (১৯৯৬)' ও 'মুক্তির কথা (১৯৯৯)' প্রামাণ্যচিত্র দু'টি। এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেছেন 'নারীর কথা', 'ইন দ্য নেইম অব সেফ্‌িট', 'আ কাইন্ড অব চাইল্ডহুড', 'ভয়েসেস অব চিলড্রেন'র মতো প্রামাণ্যচিত্রগুলো। পাশাপাশি বেশকিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন তারেক মাসুদ। তার নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিগুলো হলো- সোনার বেড়ি (১৯৮৫), সে (১৯৯৩), নরসুন্দর (২০০৯), শিশু কথা (১৯৯৭), নিরাপত্তার নামে (১৯৯৯), বিপন্ন বিস্ময়, নিরপরাধ ঘুম, 'সুব্রত সেনগুপ্ত ও সমকালীন বঙসমাজ' এবং 'ইউনিসন' (এনিমেশন)। ২০০২ সালে তারেক মাসুদ নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মাটির ময়না' চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। 'মাটির ময়না' প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এডিবনার্গ, মন্ট্রিল, কায়রো উৎসবেও 'মাটির ময়না' প্রদর্শিত হয়। পাশাপাশি ২০০২ সালে মারাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার লাভ করে। ২০০৩ সালে করাচি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সেরা ছবির পুরস্কার লাভ করে ছবিটি। ২০০৪ সালে ব্রিটেনের ডিরেক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। এরপর ২০০৬ সালে 'অন্তর্যাত্রা' এবং ২০১০ সালে 'রানওয়ে' নামে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসিত হন তারেক মাসুদ। সেই সব সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি হাত দিয়েছিলেন নতুন ছবি 'কাগজের ফুল' নির্মাণে। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ছবিটির লোকেশন দেখতে মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন তারেক মাসুদ। ফেরার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের জোকায় বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া গতির একটি বাসের সঙ্গে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তারেক মাসুদের বন্ধু চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরসহ আরও তিনজন ঘটনাস্থলেই মৃতু্যবরণ করেন। প্রতি বছরই তারেক মাসুদের জন্মদিন-মৃতু্যদিনকে ঘিরে নানা আয়োজন হাতে নেয় বিভিন্ন সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র সংগঠন। এই নির্মাতা চিরসবুজ হয়ে থেকে যাবেন বাংলা চলচ্চিত্রের ব্যতিক্রমী ভাবনায় বিশ্বের দরবারে ঢাকাই সিনেমার যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে।