বাংলাদেশ গ্রম্নপ থিয়েটার ফেডারেশনের অচলাবস্থা কাটাতে কিংবা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির প্রধান আহ্বায়ক ছিলেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। সেই তিনিই কিনা মাসপূর্তির আগেই লিখে বসলেন অব্যাহতিপত্র! শুধু তিনি একা নন, পুরো আহ্বায়ক কমিটির বিলোপ চেয়েছেন তিনি এই অব্যাহতিপত্রে। মঙ্গলবার এই নাট্যজন সংস্কারের বদলে সংঘাতের কারণ দেখিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন লিখিত চিঠিতে। যার প্রাপক গ্রম্নপ থিয়েটার ফেডারেশনের ২৩২টি নাট্য সংগঠনের সদস্যরা! চিঠির বিষয়টি মামুনুর রশীদ নিশ্চিত
করেছেন গণমাধ্যমকে। তবে এ বিষয়ে এখনই
মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
২৫ অক্টোবর ফেডারেশনের নির্বাহী পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ সভায় অভিনেতা-নির্দেশক মামুনুর রশীদকে প্রধান করে ফেডারেশন পুনর্গঠন ও সংস্কারের জন্য পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছিল।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অধ্যাপক মলয়
ে
ভৗমিক, আহমদ ইকবাল হায়দার, নাদের চৌধুরী
ও নাজনীন হাসান চুমকি।
আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক মলয় ভৌমিক গণমাধ্যমে বলেন, 'ফেডারেশনের সাধারণ সভায় এই আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছিল, এখন সদস্যদের কাছেই আমরা অব্যাহতি চেয়েছি। কারণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে কাজের জায়গাটা আমাদের মিলছে না।'
এই নাট্যজন আরও বলেন, 'আহ্বায়ক কমিটি যখন করা হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল ফেডারেশন পুনর্গঠনের জন্য সব সিদ্ধান্ত আহ্বায়ক কমিটিই নেবে। আর রুটিনমাফিক কাজ করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটিকেও রাখা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি মূলত আহ্বায়ক কমিটিকে সহায়তা করার কথা। কিন্তু এখন কাজের পদ্ধতিগত কিছু সংঘাত তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আহ্বায়ক কমিটির পক্ষে সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করছি।'
কথাগুলো মামুনুর রশীদের অব্যাহতিপত্রেও রয়েছে। যেখানে শেষে তিনি লিখেছেন, তাকেসহ আহ্বায়ক কমিটির বর্তমান সদস্যদের বাদ দিয়ে বরং অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন করে কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তিনি মনে করেন, 'ফেডারেশনকে সুন্দর ও সুচারুভাবে পরিচালনার পথ অনুসন্ধান করা উচিত।'
গত ২৫ অক্টোবর ফেডারেশনের নির্বাহী পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ সভায় স্থায়ী সদস্য ২৩২টি নাট্য সংগঠনের মধ্যে ১৯১টির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় সবার সম্মতিতে ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীকে বহিষ্কার করে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য লাকী ইনামকে। পাশাপাশি সংস্কারের জন্য মামুনুর রশীদকে প্রধান করে গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি।
মামুনুর রশীদ একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে সমান তালে কাজ করে দর্শকহৃদয়ে জায়গা করে নেন তিনি। ইতোমধ্যে পাঁচ দশকের বেশি সময় অভিনয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন এই অভিনেতা। মামুনুর রশীদ তার নাটকে শ্রেণিসংগ্রাম, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের নানা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক ইসু্য তুলে ধরেন। লেখা ও নির্দেশনার মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন নাট্যজগতে অপরিহার্য একজন।
স্কুলজীবনে অভিনয় করতেন মামুনুর রশীদ। অভিনয়ের নেশা তখনই তৈরি হয় এই অভিনেতার। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়ার সময়ই মামুনুর রশীদ তার প্রথম নাটক লেখেন। নাটকটির নাম- 'মহানগরীতে
একদিন'। তবে অভিনয় পেশা হবে, এমনটা কোনো
দিন ভাবেননি তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাবলেন, অভিনয়টাই জীবিকা হবে তার।
১৯৬৭ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে শুরু করেন মামুনুর রশীদ। তবে তার নাটকের বিষয়বস্তু ছিল মূলত পারিবারিক। সে সময় কমেডি নাটকও লিখতেন এই অভিনেতা। নাট্যশিল্পের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা শুরু হয় টাঙ্গাইলে তার নিজ গ্রামে যাত্রা ও লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে অভিনেতার নিবিড় পরিচয়ের সূত্র ধরে। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং জড়িত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন তার প্রথম রচিত নাটক 'পশ্চিমের সিঁড়ি' কলকাতার রবীন্দ্রসদনে মঞ্চায়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আগেই ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা অর্জন করায় নাটকটি আর তখন মঞ্চায়িত হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে মঞ্চায়িত হয় নাটকটি। সেই সময়টাও তার নাট্যচর্চায় প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হয় তার আরেক নাট্যসংগ্রাম 'মুক্ত নাটক আন্দোলন'। ১৯৭২ সালে কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেই মামুনুর রশীদ তৈরি করেন 'আরণ্যক নাট্যদল'।
মামুনুর রশীদের উলেস্নখিত মঞ্চ ও টিভি
নাটকগুলো হলো-
মঞ্চ- 'পশ্চিমের সিঁড়ি', 'গন্ধর্ব নগরী', 'ওরা কদম আলী', 'অববাহিকা', 'জয় জয়ন্তী', 'সংক্রান্তি', 'বনাম রাঢাং'।
ধারাবাহিক টিভি নাটক- 'অলসপুর', 'সুন্দরী' ও 'মুর্দা ফরেশ'।