বাংলাদেশের সঙ্গীত অঙ্গনে অনেক মেধাবী সঙ্গীত শিল্পীকে প্রান্তিক পর্যায় থেকে তুলে এনে সেলিব্রটির আসনে বসিয়েছে সঙ্গীত বিষয়ক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ক্লোজআপ ওয়ান। বেশকিছু শিল্পী এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। কোনো কোনো শিল্পী নিতান্ত পাড়ার মঞ্চ থেকে চলে এসেছেন টিভি'র পর্দায়। গানের মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের হৃদয়ের গভীরে। মানুষের ভালোবাসায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সঙ্গীত জগতে।
২০০৫ সালে যাত্রা শুরু হয় সঙ্গীতবিষয়ক রিয়েলিটি শো 'ক্লোজআপ ওয়ান : তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ'। দ্বিতীয় আসর অনুষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। পরে এক বছর বিরতি দিয়ে তৃতীয় আসর ২০০৮ সালে এবং সর্বশেষ আসর অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। সর্বশেষ আসরে বিজয়ীর মুকুট উঠেছিল নাটোরের মেয়ে লায়লার মাথায়। এ রিয়্যালিটি শোয়ের প্রধান তিন বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন- ইমতিয়াজ বুলবুল, ফাহমিদা নবী
এবং পার্থ বড়ুয়া।
ক্লোজআপ ওয়ানের প্রথম আসরের প্রথম বিজয়ী ছিলেন নোলক বাবু। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা একজন গায়ক। যার কোনো গানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ছিল না কোনো সাধারণ শিক্ষাও। তবুও মানুষের আবেগ ও ভালোবাসায় প্রথমবারের আসরে চ্যাম্পিয়ন হন এ শিল্পী। কিন্তু খুব বেশিদিন তার চলার পথের চাকা সচল থাকেনি। তারকাখ্যাতি বয়ে বেড়াতে পারেননি তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই হারিয়ে যান। এখন 'করে খাচ্ছি' টাইপের কাজ করলেও নোলকের ব্যাপারে শ্রোতা-দর্শকের উদাসীনতা বেশ লক্ষণীয়। তবে এ শিল্পী নিয়মিত চেষ্টা করে যাচ্ছেন দর্শকের হৃদয়ে ভালো গান দিয়ে আগের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করার।
রোববার প্রয়াত শিল্পী বারী সিদ্দিকীর ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে বারী সিদ্দিকী স্মৃতি পরিষদের আয়োজনে বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বারী সিদ্দিকী স্মরণে স্মৃতি চারণ, গুণীজন সম্মাননা ও আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন শিল্পী নোলক বাবু। সেখানে আলাপকালে দৈনিক যায়যায়দিনকে বলেন, বারী স্যারের একটি একক আ্যলবামে আমি কাজ করেছিলাম। অ্যালবামের পুরটাই স্যার সঙ্গীত ও সুর করেছিলেন। গানগুলোর কথা লিখেছিলেন শহীদুলস্না ফরায়জী। অ্যালবামের নাম হলো 'দুই চোখের কান্দন'। এ কাজটি করতে পেরে আমি খুবই ভাগ্যবান। বারী স্যার আমাদের হৃদয়ে সবসময় থাকবেন। আপনারা স্যারের জন্য দোয়া করবেন। আমি যত দিন বেঁচে আছি বারী স্যারের গান গেয়ে যাব।
ক্লোজআপ ওয়ানের দ্বিতীয় আসরের সেরা আবিষ্কার সালমা আক্তার। লালন কন্যাখ্যাত সালমা ২০০৬ সালে ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। কণ্ঠ শৈলীর গুণে শ্রোতারা তাকে বেশ আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করেছেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সালমার। নিজ গুণে এগিয়ে গিয়েছেন। পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। সালমা নিয়মিত গান গেয়ে যাচ্ছেন। দর্শকদের উপহার দিচ্ছেন শ্রম্নতিমধুর গান। এ শিল্পী ব্যস্ত থাকেন স্টেজ শো নিয়েও। গানের মাঝেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন এ শিল্পী।
২০০৬ সালের ক্লোজআপ তারকা রিংকু। বাউল, মরমি ও সুফি ঘরানার গানের শিল্পী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান রিংকু। অল্পসময়ে শ্রোতামনে জায়গা করে নেন রিংকু। সেই সময় দুর্দান্ত ব্যস্ত শিল্পী হয়ে পড়েন তিনি। রিংকু এবং তার বন্ধুরা মিলে গড়ে তুলেছিলেন সম্পর্ক নামের একটি মিউজিক স্টুডিও। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সেই রিংকু এখন আর আগের মতো নেই। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছেন তিনি। পরপর চারবার স্ট্রোক করেছেন রিংকু। সবশেষ ২০২০ সালে দুইবার স্ট্রোক হওয়ায় তার শরীরের বাঁপাশ অবশ হয়ে গেছে। এরপর থেকেই গান থেকে দূরে আছেন তিনি। থাকছেন গ্রামে। কাটাচ্ছেন দুর্বিষহ জীবন।
জানা গেছে, বর্তমানে গ্রামের বাড়ি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার বড় সাওতায় বসবাস করছেন রিংকু। আগের চেয়ে এখন কিছুটা সুস্থ। তবে তার হাঁটাচলা এখনো স্বাভাবিক না। স্থানীয় এলাকাবাসী অনেকেই জানিয়েছেন, যদি এই শিল্পীকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানো যেত, তাহলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেন। এদিকে রিংকুর মনও পড়ে আছে গানের ভুবনে। কবে নতুন গান আর মাইক্রোফোন হাতে স্টেজে উঠবেন সেই অপেক্ষায়। এই গায়কের কথায়, একটা সময় স্টেজ মাতিয়েছি। নতুন নতুন গান করেছি। কিন্তু এখন সব বন্ধ। আমাকে অনেকেই ডাকেন গানের জন্য। কিন্তু এ অবস্থায় গাইতে পারি না, তাই যাই না। রিংকু আরও বলেন, আমি যে গানগুলো গেয়েছি, আমার কণ্ঠের গান যারা পছন্দ করেন- তারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন, যাতে আগের মতো গাইতে পারি। কিন্তু আগের মতো গাওয়া সম্ভব নয়, তারপরও চেষ্টা করব।
২০০৮ সালের ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় প্রথম হন সানিয়া সুলতানা লিজা। একক অ্যালবামের পাশাপাশি কয়েকটি মিক্সড অ্যালবামে গান করেন এ শিল্পী। অ্যালবামের গানের বাইরে পেস্ন-ব্যাকও করছেন তিনি। বলা যায় অনেকটা জনপ্রিয়তার তকমা জুড়েছেন নিজের নামের সঙ্গে। গান থেকে কিছুদিন বিরতিতে ছিলেন এ শিল্পী কারণ প্রথম বার কন্যাসন্তানের মা হয়েছেন। বিরতি কাটিয়ে আবারও গানে নিয়মিত হয়েছেন লিজা। নিজের কণ্ঠে মৌলিক গান প্রকাশেও মনোযোগী হয়ে উঠেছেন তিনি। লিজার নতুন মৌলিক গান 'তুমি এলে'। এ গানটি লিখেছেন নূরুল ইসলাম মানিক, সুর করেছেন ফয়সাল আহমেদ, সঙ্গীতায়োজন করেছেন মীর মাসুম। গানটি লিজার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ পেয়েছে। এদিকে লিজার দীর্ঘদিনের একটা স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক নকীব খানের সুরে লিজার একটি গান গাওয়ার ইচ্ছে ছিল। অবশেষে তার সেই স্বপ্ন
পূরণ হয়েছে।
ড. শোয়েব আহমেদের লেখা 'পূর্ণিমা চাঁদ' শিরোনামের একটি গানের সুর করেছেন নকীব খান। যে গানটির সঙ্গীতায়োজন করেছেন ফোয়াদ নাসের বাবু। আর এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েই লিজার স্বপ্ন পূরণ হয়। গানটির মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেছেন রাজ বিশ্বাস শংকর। গানটি লিজার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে।