একটা সময় ছিল যখন সিনেমা মানেই নায়ক-ভিলেনের লড়াই! সিনেমায় নায়কের যেমন পরিচিতি লাভ হতো, তেমনি ভিলেনেরও। পর্দায় খলনায়কদের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে হলজুড়ে বইতো উন্মাদনা আর উচ্ছ্বাসের ঢেউ। সেসব যেন সোনালি অতীতের কথা! তেমনই এক খলনায়ক ছিলেন ওয়াসীমুল বারী রাজীব। সাদামাটা চরিত্রের অভিনয়ের পাশাপাশি তার দরাজ কণ্ঠে খলনায়কের বীভৎসতা প্রাণ পেত, আবার দর্শকও উপভোগ করত। যতক্ষণ পর্দায় থাকতেন ততক্ষণই চরিত্রকে শাসন করতেন তিনি।
সেই শক্তিমান অভিনেতা রাজীবের ২০তম মৃতু্যবার্ষিকী ছিল গত বৃহস্পতিবার। ২০০৪ সালে ১৪ নভেম্বর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫২ বছরেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তবে অভিনেতা হিসেবে এখনো মানুষের হৃদয়ে রয়েছেন। প্রায় দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন রাজীব। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে খল অভিনেতা হিসেবেই বেশি খ্যাতি তার। ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি পটুয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সিনেমায় আসার আগে তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে চাকরি করতেন প্রয়াত এ অভিনেতা।
রাজীবের অভিনয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার কণ্ঠ। কণ্ঠের দরাজ অভিব্যক্তি দর্শককে মুগ্ধ করত। দরাজ কণ্ঠে 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত', 'দেনমোহর' ছবিগুলোতে আহমেদ শরীফের সঙ্গে রাজিবের অভিনয়ের অংশগুলো স্মরণ করলেই বোঝা যাবে। 'স্বপ্নের পৃথিবী' ছবিতে অমর নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে রাজা-প্রজার জবাবদিহির সময় খোলা মাঠের তর্কের দৃশ্যটি মনে করলেও বোঝা যায় তার ভরাট কণ্ঠের জাদু।
তিনি সব সময় সিনেমার চিত্রনাট্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শুটিং সেটে মেনে চলেছেন পরিচালকের নির্দেশনা। অভিজ্ঞতা ও আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কখনো অহংকার করতেন না এই অভিনেতা। নিজের চরিত্র যেমনই হোক সেটা নিয়ে বারবার রিহার্সেল করতেন। ছাড়িয়ে যেতে চাইতেন সিনেমার অন্য সব চরিত্রগুলোকে।
শিল্পীরাও পছন্দ করতেন তাকে। শিল্পীদের নানা বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহকে তিনি ছেলে মনে করতেন। সালমান শাহও রাজীবকে সিনেমা অঙ্গনে বাবা বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। শিল্পীদের ভালোবাসা নিয়ে শিল্পী সমিতির নেতৃত্বও দিয়েছেন বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে। এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও হয়েছিলেন এই অভিনেতা।
ভিলেন হিসেবে রাজীব তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। অথচ মজার ব্যাপার হলো ঢালিউডে তার আগমন ঘটেছিল নায়ক হিসেবে। ১৯৮১ সালে 'রাখে আলস্নাহ মারে কে' ছবিতে প্রথম তিনি নায়ক হয়ে অভিনয় করেন। তবে তিনি তারকাখ্যাতি পান কাজী হায়াৎ পরিচালিত 'খোকনসোনা' ছবিতে অভিনয় করে। ছবিটিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন কাজী মারুফ। এছাড়া 'দাবি' নামের আরেকটি ছবিতেও নায়ক ছিলেন। আশির দশকের শেষদিকে তিনি ভিলেন হিসেবে যাত্রা করেন। সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় ভিলেন হিসেবেই তিনি থিতু হন।
পজেটিভ চরিত্রেও রাজীব ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভালো চরিত্রে হাজির হয়ে রাজীব দর্শক হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন বারবার। বিশেষ করে 'স্নেহের প্রতিদান' ছবিতে অভিনেতা রাজীবের অভিনয় ছিল অনিন্দ্য। সে ছবি যারা দেখেছেন তাদের রাজীবের কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল অবলীলায়। এছাড়াও 'বিদ্রোহ চারিদিকে', 'অন্তরে অন্তরে', 'জিদ্দি', 'অপরাজিত নায়ক', 'অন্ধ ভালোবাসা', 'ঘায়েল', 'প্রেম পিয়াসী', 'অন্যমানুষ' ইত্যাদি ছবিতেও ইতিবাচক চরিত্রে দর্শক মাতিয়েছিলেন রাজীব।
রাজীবের উলেস্নখযোগ্য সিনেমার মধ্যে- বিদ্রোহী, পরাণপাখি, জীবনধারা, ভাত দে, মানিক রতন, সম্রাট, শক্তি, মায়ের দাবি, যন্ত্রণা, রাজভিখারি, নকল শাহজাদা, বেরহম, মিয়াভাই, হিসাবনিকাশ, আন্দাজ, অহিংসা, পুষ্পমালা, জারকা, নবাব, সাহেব, খামোশ, উসিলা, দাগী, কাবিন, আওয়াজ, আয়নামতি, চাচা ভাতিজা, চন্দনা ডাকু, অবিশ্বাস, নিয়ত, হীরামতি, চাঁদাবাজ, দাঙ্গা, বিদ্রোহ চারিদিকে, রক্তের বদলা, দেশদ্রোহী, মীরজাফর, হিংসার আগুন, শেষ সংগ্রাম, শেষ খেলা, বুকের ভিতর আগুন, সত্যের মৃতু্য নেই, প্রেম দিওয়ানা, অপরাজিত নায়ক, জিদ্দি, ডন, বাবার আদেশ, স্নেহের প্রতিদান, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, দেনমোহর, প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের ঠিকানা, স্বপ্নের পৃথিবী, অন্তরে অন্তরে, বিক্ষোভ, মহামিলন, বিদ্রোহী আসামী, সত্য মিথ্যা, হুমকি, বীরাঙ্গনা সখিনা, মা মাটি দেশ, প্রেম প্রতিজ্ঞা, টাকার অহংকার, শয়তান মানুষ, দুর্নীতিবাজ, মিথ্যার রাজা, আজকের প্রতিবাদ, একজন বিদ্রোহী, প্রিয় তুমি, বিদ্রোহী কন্যা, বিদ্রোহী সন্তান, লক্ষ্ণীর সংসার, প্রেম বিরহ, শেষ রক্ষা, ঘায়েল, হাঙর নদী গ্রেনেড, ভালোবাসা কারে কয়, ভালোবাসি তোমাকে, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ভাইয়া, বাঘের বাচ্চা, খতম, পড়ে না চোখের পলক, ভালোবাসার দুশমন, মায়ের সম্মান, স্বপ্নের বাসর, স্বপ্নের পুরুষ, জামাই শ্বশুর ইত্যাদি।
অভিনেতা রাজীব চলচ্চিত্র প্রযোজনাতেও সফল হয়েছেন। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ফ্রেন্ডস মুভিজ। বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তিনি উপহার দিয়েছেন প্রযোজক হিসেবে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে রাজীব চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার ভূমিকায়। 'হীরামতি' ছবি দিয়ে ১৯৮৮ সালে প্রথম পুরস্কার ঘরে তুলেন তিনি। এরপর ১৯৯১ সালে 'দাঙ্গা', ২০০০ সালে 'বিদ্রোহ চারিদিকে', ২০০৩ সালে 'সাহসী মানুষ চাই' ছবির জন্য পুরস্কার পান।