সাবলীল বাক্যে অজস্র গল্প নদীর মতো বয়ে চলছে। মাঝরাতে হিমুর রাস্তায় ঘেুারাঘুরি, ছাদে দাঁড়িয়ে রুপার অপেক্ষা, তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকানো মিসির আলি, শুভ্র এবং বাকের ভাই। কোনো দিন বুঝি শেষ হবে না; বরং কেটে যাবে কৈশোর এবং তারুণ্য। সত্যি বলতে বাঙালি পাঠককে এতটা পরিব্যপ্ত করে আর কেউ ছুঁতে পারেনি আগে। যতটা পেরেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ একজন জাদুকর; একটা বিপস্নবের জন্মদাতা।
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ নানার বাড়িতে। পিতার বাড়ি নেত্রকোনাতেই কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে। পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্তব্যরত অবস্থাতেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হন।
পারিবারিকভাবেই সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখিতে আগ্রহ ছিল ব্যাপক। 'দীপ নেভা যার ঘরে' শিরোনামে তার পিতার একটি বই প্রকাশিত হয় বগুড়ায় থাকাকালে। ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিশু-কিশোর এবং সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবে জনপ্রিয়। আরেক ভাই আহসান হাবীব রম্যলেখক ও কার্টুন ম্যাগাজিন 'উন্মাদ'-এর সম্পাদক। মা আয়েশা ফয়েজের 'আত্মজীবনী' প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। এসব থেকে অন্তত তার পারিবারিক শিকড় সম্পর্কে ধারণা আসে। ছেলেমেয়েদের নিত্য নাম পরিবর্তনের অদ্ভুত এক খেয়াল ছিল ফজলুর রহমানের। খোদ হুমায়ূন আহমেদের নামই রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। হুমায়ূন আহমেদ অবশ্য স্বীকার করেছেন; পিতা বেঁচে থাকলে হয়তো আরও কয়েক দফা নামের পরিবর্তন ঘটত। সে যা-ই হোক, ছয় ভাই-বোনের মধ্যে হুমায়ূন সবার বড়।
সরকারি চাকরির জন্য কোথাও থিতু হতে পারেনি তার পরিবার। এজন্য শিক্ষাজীবনের সূচনা সিলেটের কিশোরীমোহন পাঠশালায় হলেও ম্যাট্রিক পাস করেন বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে। তারপর ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি। পেশাজীবনে প্রথমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ ১৯৯০ সাল থেকে। ১৯৭৩ সালে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন গুলতেকিনের সঙ্গে। ২০০৩ সালে বিচ্ছেদের আগে পর্যন্ত তিন মেয়ে, এক ছেলে। ২০০৫ সালে বিয়ে করেন মেহের আফরোজ শাওনকে। সেই সংসারে দুই পুত্র।
ছাত্রজীবনেই লেখা 'নন্দিত নরকে' উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তার আগমন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দিতে থাকেন একের পর এক স্বতন্ত্র নির্মাণ। সাহিত্যের গতানুগতিক দেয়াল এবং নিয়মকে ডিঙিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন নিজের পৃথিবীকে। রচনা করতে থাকেন গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ রচনা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ এবং আত্মজীবনী। নাটক এবং চলচ্চিত্রেও সোনা ফলালেন হাত ভরে। শুধু গ্রন্থের সংখ্যাই তিন শতাধিক।
তাকে বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃত বললেও ভুল হবে না। 'বাদশাহ নামদার'-এর মতো ঐতিহাসিক রচনা, 'জোছনা ও জননীর গল্প'র মতো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস কিংবা 'তোমাদের জন্য ভালোবাসা'র মতো সায়েন্স ফিকশন পরবর্তীকালে স্ব স্ব ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়। তার নাটক 'কোথাও কেউ নেই' এতটাই দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে যে অন্যতম প্রধান চরিত্র বাকের ভাইয়ের মৃতু্যদন্ড দেওয়া হলে তার প্রতিবাদে ঢাকায় মিছিল বের হয়। 'শ্যামল ছায়া' চলচ্চিত্রটি সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নির্বাচিত হয়। সফল এবং সুস্থ ধারার সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমে দর্শকদের পুনরায় হলমুখী করেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্রের জন্য বেশ কিছু গান লিখেছেন। তার সবগুলো গানই শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরে। এককথায় বলতে গেলে তার লেখা একটা গানও শ্রোতাবিমুখ হয়নি।
তার উলেস্নখযোগ্য গানগুলো হচ্ছে- 'একটা ছিল সোনার কন্যা', 'বরষার প্রথম দিনে', 'যদি মন কাঁদে', 'ও আমার উড়াল পঙ্খীরে', 'আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা', 'মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ', 'লিলুয়া বাতাস', 'বাজে বংশী', 'আমার আছে জল' ও 'চাঁন্নীপসরে কে আমারে স্মরণ করে'।
এর মধ্যে 'একটা ছিল সোনার কন্যা' গানে কণ্ঠ দিয়ে সুবীর নন্দী ২৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এর সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন মকসুদ জামিল মিন্টু। পরের বছরই 'বরষার প্রথম দিনে' গানের জন্য সাবিনা ইয়াসমিন ২৫তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। হুমায়ূন আহমেদের চিত্রনাট্য ও পরিচালনার ছবিগুলোর মধ্যে 'আগুনের পরশমণী', 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী', 'চন্দ্রকথা', 'শ্যামল ছায়া' প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য।
১৯৮০-১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ধারাবাহিক এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রচনা শুরু করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে তার প্রথম টিভি কাহিনিচিত্র 'প্রথম প্রহর' বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়। এটি তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে।
তার অন্যতম টেলিভিশন ধারাবাহিকগুলো হচ্ছে- 'এইসব দিনরাত্রি', 'বহুব্রীহি', 'কোথাও কেউ নেই', 'নক্ষত্রের রাত', 'অয়োময়', 'আজ রবিবার', 'নিমফুল', 'তারা তিনজন' 'মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম', 'সবুজ সাথী', 'উড়ে যায় বকপঙ্খী', 'এই মেঘ এই রৌদ্র'।
পরবর্তী সময়ে তিনি বহু এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেন। এর মধ্যে 'খেলা', 'অচিন বৃক্ষ', 'খাদক', 'একি কান্ড', 'একদিন হঠাৎ', 'অন্যভুবন' উলেস্নখযোগ্য। অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের অবদানস্বরূপ হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা।
প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। গাজীপুরে 'নুহাশ পলস্নী' এবং সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে 'সমুদ্র বিলাস' তার অন্যতম উদাহরণ। নীরবে নিভৃতে বসে লিখে গেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। কিন্তু তার গল্পগুলোর মতোই বড় অসময়ে অনেক কথা বাকি রেখেই সমাপ্তি ঘটল হুমায়ূনের জীবনের। ১৯ জুলাই ২০১২ সালে নিউইয়র্কে মৃতু্যবরণ করেন এই কিংবদন্তি। গাজীপুরের নুহাশ পলস্নীতেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে।