গান বাংলার ছদ্মবেশে তাপসের অজানা গল্প
প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বিনোদন রিপোর্ট
ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে গা-ঢাকা দেওয়া গান বাংলা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কৌশিক হোসেন তাপস গ্রেপ্তার হয়েছেন। একজন তবলচি থেকে টিভি চ্যানেলের কর্ণধার হওয়া তাপস বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা কারণে আলোচিত ছিলেন। 'জয় বাংলা কনসার্ট'-এর আলোচিত সংগঠক ছিলেন তিনি। তার উত্থান নিয়েও নানা মুখরোচক গল্পের ছড়াছড়ি মিডিয়াপাড়ায়।
কৌশিক হোসেন তাপস ছিলেন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের তবলা বাদক। তার স্ত্রী ফারজানা মুন্নী ছিলেন বিগত ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার বিউটিশিয়ান। মূলত স্ত্রীর হাত ধরেই রাতারাতি একের পর এক সিঁড়ি টপকে সামান্য একজন তবলা বাদক থেকে মিডিয়া মাফিয়া বনে যান তাপস।
মিডিয়াতে তার চরিত্রটাই ছিল বেশ 'রহস্যময়'। একসময়ের তবলচি কয়েক বছরের ব্যবধানেই একটি চ্যানেলের মালিক হয়ে যান। তার মূল কলকাঠি নড়াচড়ায় ছিলেন তার স্ত্রী ফারজানা মুন্নী।
অভিযোগ আছে, গান বাংলার নাম করে ইউক্রেন ও বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে নারী এনে তাদের অনৈতিক কাজে ব্যাবহার করতেন তাপস। এভাবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন তিনি।
২০২২ সালের মার্চে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঢাকায় সানি লিওনকে নিয়ে আসেন তিনি। সেসময় তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, সানি লিওনকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু নিজের মেয়ের বিয়েতে এই বলিউড তারকাকে নাচাবেন বলে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই ঢাকায় সানি লিওনকে নিয়ে আসেন তাপস। ১৩ ঘণ্টার সফর শেষে কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই দেশ ছাড়েন অভিনেত্রী।
এছাড়া ভারতীয় অনেক নায়িকাকে অনুষ্ঠানের নামে নিয়মিত ঢাকায় আনতেন। এদের মধ্যে নুসরাত জাহান, মিমি চক্রবর্তী, নার্গিস ফাখরিসহ অনেকেই আছেন। এসব তারকাকে দিয়েও বিভিন্ন প্রভাবশালীদের তাপস নানান সেবা দিতেন বলে কানাঘুষা আছে।
এত কিছুর মাঝেও কৌশিক হাসান তাপস ও ফারজানা মুন্নীর মধুর সংসারের ফাটল প্রকাশ্যে আসে ২০২৩ সালের শেষের দিকে। যখন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের সঙ্গে ফারজানা মুন্নীর একটি কলরেকর্ড ফাঁস হয়। ওই কলরেকর্ডে মুন্নীকে বলতে শোনা যায়, তাপস অভিনেত্রী শবনম বুবলীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তাদের দু'জনকে হাতেনাতেও ধরেছেন তিনি। মুন্নী আরও দাবি করেন, বুবলী তার সংসার ভাঙার চেষ্টা করছে। তবে প্রতিবারের মতো এই ঘটনাও দারুণভাবে সামলে নেন তাপস। কিছুদিন পরই স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে দাবি করেন, তাদের মাঝে সামান্য ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল। তবে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর মতো কোনো কাজ তিনি করেননি।
তাপসের অপকর্মের শেষ নেই। অভিযোগ আছে, গান বাংলা চ্যানেলটি আবৃত্তিশিল্পী রবিশঙ্কর মৈত্রীর হলেও জোর করে ভাগিয়ে নেন তাপস। ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে গান বাংলা টেলিভিশনের লাইসেন্স পান রবিশঙ্কর। ২০১২ সালের পহেলা জুলাই কৌশিক হোসেন তাপস আর ফারজানা মুন্নী ৮০ লাখ টাকায় শেয়ারহোল্ডার হিসেবে গান বাংলায় যুক্ত হয়েছিলেন। একটা সময় রবিশঙ্করকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গান বাংলার সবকিছুই নিজের
করে নেন তাপস-মুন্নী।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে কনসার্ট আয়োজনের কাজও বাগিয়ে নিতেন তাপস। সেসবের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আয়োজিত লাল-সবুজের মহোৎসব, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান অন্যতম। সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। আর এসব কাজে অধিকাংশ সময়ই তাপস ব্যবহার করতেন তার জাদুর কাঠি 'ফারজানা মুন্নী'
ও চ্যানেলের নাম করে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা তরুণীদের।
মুন্নীর সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সখ্য, বিশেষ করে শেখ হাসিনার 'আস্থাভাজন' পরিচয় কাজে লাগানো ও বিদেশি তরুণীদের দিয়ে 'মনোরঞ্জন'-এর ব্যবস্থা করা ছিল এই ধূর্ত মিডিয়া মাফিয়ার অন্যতম হাতিয়ার।
এদিকে তাপসের হয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তার মা মেহের নিগার চঞ্চল। তিনি বলেন, যে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাপস এতে জড়িত না। যদি বিপথগামী হয়েই থাকে এর জন্য শেখ হাসিনা দায়ী। গতকাল সকালে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
তাপসের মা বলেন, ২০১২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে একটি গানের অনুষ্ঠান থেকে তাপসকে তুলে নেওয়া হয়। তারপর থেকে এই ১২ বছরে বারোবারও তার দেখা পাইনি। তখন থেকে শেখ হাসিনা সরকার আমাকে একা করে দিয়েছে। ওই সময় তাকে তুলে নেওয়ার এক বছর পর যেখানে পেয়েছি, তা আর বলতে চাই না। মেহের নিগার বলেন, অপরাজনীতির কারণে ১৯৭৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আমি নেই। তিনি বলেন, আমি ব্যথিত, দুঃখিত। তার বিরুদ্ধে যে মামলা দিয়েছে তা ঘৃণ্যতম কাজ, রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। আমার সন্তান কখনোই এই মামলার জড়িত হতে পারে না। তার দ্বারা এ কাজ হতে পারে না। আমরা তাকে সেই শিক্ষা দেইনি। সে এ কাজ করবে না। সেই গ্যারান্টি আমি দিয়ে যাচ্ছি। এই বয়সের তার জন্য সাহায্য চাচ্ছি।
জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ঘটনায় রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল গান বাংলার প্রধান নির্বাহী কৌশিক হোসেনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। ইশতিয়াক মাহমুদ নামে একজন ব্যবসায়ী হত্যাচেষ্টার এ মামলাটি করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে থেকে গান-বাজনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ক্যাডারদের উৎসাহ ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে গান বাংলার তাপস।
গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে আসামিদের ছোড়া গুলিতে বাদীর পেটে গুলি লাগে। গুরুতর আহত হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে থেকে অপারেশনের মাধ্যমে তার পেটের গুলি বের করা হয়। এ ঘটনায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর ইশতিয়াক মাহমুদ বাদী হয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুনসহ ১২৬ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় তাপস এজাহারভুক্ত ৯ নম্বর আসামি।