ঢাকাই সিনেমার বিতর্কিত নায়িকা নিপুণ আক্তার। ২০০৬ সালে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই পাল্টে যায় তার জীবনধারা। শেখ সেলিমের ছত্রছায়ায় একের পর এক সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেন। বাগিয়ে নেন নিপুণের মতো সাধারণ মানের নায়িকাও একাধিক বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
গত ৫ আগস্টের পর গত স্বৈরাচার সরকারের পক্ষে ফেসবুকে বেশ কয়েকটি পোস্ট করেন তিনি। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রচারণামূলক কাজেও নিয়মিত পাওয়া যেত নিপুণকে। শুধু তাই নয়, শেখ সেলিম ও আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিতে নিজের প্রভাব খাটান তিনি। এমনকি তার এই খুটির জোরেই শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার দখল করেন। কাউকে তোয়াক্কা না করে তার একক সিদ্ধান্তেই চলত সমিতি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন দিয়ে। সেবার নির্বাচনে সভাপতি পদে ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রাথমিক ভোট গণনায় জায়েদ খান জয়ী হন। জায়েদ খানের কাছে ১৩ ভোটে পরাজিত হন চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার। ফলাফলে অসন্তোষ জানিয়ে ভোট পুনর্গণনার জন্য আপিল করেন নিপুণ। কিন্তু সেখানেও একই ফলাফল পায় আপিল কমিটি। পরে ঘটনা মামলায় গড়ায়। আদালত থেকে রায় নিয়ে শিল্পী সমিতির চেয়ারে বসেন নিপুণ। তিনি পুরো সময় দায়িত্ব পালন করেন। অভিযোগ রয়েছে এর পেছনে সরাসরি প্রভাব রয়েছে এক রাজনৈতিক নেতা শেখ সেলিমের। নির্বাচনে তাকে জয়ী করতে নির্বাচন কমিশনারদের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখান তিনি।
একাধিক নির্বাচন কমিশনার শিল্পী সমিতির নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেন। নাম প্রকাশ না করে তাদের একজন বেশ কিছু দিন আগে গণমাধ্যমকে বলেন, জীবনের হুমকি ছিল। যেকোনো সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে, এমন শঙ্কা ছিল। তিনি বলেন, 'আমাদের নির্বাচন কমিশনারদের একের পর এক ভয়ভীতি দেখিয়ে গালিগালাজ করা হয়। বলা হয় যে পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে যাবে। এমন লেভেল থেকে ফোন আসবে, ভাবতেই পারিনি। আমাদের একজনকে সেই সময় নিপুণকে জয়ী করাতে ১৭ বার ফোন করেন শেখ সেলিম সাহেব, তার মতো লোক। এটা আমাদের অবাক করেছিল।'
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা পিরজাদা হারুন বলেন, ২০২২ সালের নির্বাচনে তার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়, যা তাকে মানসিকভাবে এখনো আতঙ্কিত করে। নির্বাচনে নিপুণকে জয়ী দেখাতে অনেক ওপর থেকে এক ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ একের পর এক ফোন করতে থাকেন। তিনি সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রায় সব মন্ত্রণালয়ে সরাসরি প্রভাব খাটাতেন, নিয়ন্ত্রণ করতেন বলা যায়। কিন্তু আমি সরাসরি 'না' বলে দিই।'
পরবর্তী সময় মোবাইল ফোনে ভয়ও দেখানো হয়, এমনকি বড় অঙ্কের অর্থের লোভ দেখানো হয় উলেস্নখ করে হারুন গণমাধ্যমকে বলেন, 'তখন একের পর এক ফোনে আমাকে ভয় দেখানো হয় যে তুলে নিয়ে যাবে। পরে একটা জায়গায় যেতে বলেন, যেখানে বড় অঙ্কের টাকা রাখা ছিল। যখন রাজি হলাম না, তখন ফলাফল নিয়ে মামলা করা হলো। সেটা চলে গেল কোর্টে। তখন নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আমাকে বানিয়ে দেওয়া হলো অন্য একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। নানা কান্ডে আমাকে ছোট করা হলো, এফডিসিতে নিষিদ্ধ করা হলো।'
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর থেকেই চাপের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিল্পীরা। অনেক শিল্পীই দেশ ত্যাগ করেছেন। অনেক তারকা আত্মগোপনে গেছেন। এমনকি সামাজিকমাধ্যমেও কটাক্ষের মুখে পড়ছেন অনেকেই। আওয়ামীপন্থী যেসব তারকা ছিলেন তাদের মাঝে নায়িকা নিপুণ আক্তার অন্যতম। তিনিও নাকি আত্মগোপনে আছেন। নিপুণ দেশে নাকি লন্ডনে সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আগেই গুঞ্জন উঠেছিল লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। তবে ২৩ অক্টোবর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয় দেশেই রয়েছেন নিপুণ। জানা যায়, দেশেই আত্মগোপনে আছেন নিপুণ। গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে দেশ ছাড়তে পারেননি। এই নায়িকা প্রতিনিয়ত বিদেশের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে বোঝাতে চাইছেন, দেশের বাইরে আছেন তিনি। নিপুণের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিপুণ দেশেই আছেন। তবে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না তিনি। বিভিন্ন আওয়ামী নেতার সঙ্গে এখনো তার যোগাযোগ রয়েছে। তবে মামলার ভয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন নিপুণ। আরও জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজস্ব লোক দিয়ে মিথ্যাচার করাচ্ছেন তিনি। আবার বিভিন্ন মাধ্যমে খবর ছড়িয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পরই ১০ আগস্ট সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন তিনি। বিদেশেও নাকি বাঙালি কমিউনিটির ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না বলে ছড়িয়েছেন তিনি। সেখানেও ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। সহসা দেশে ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও জানানো হয়। দেশে ফিরলে তোপের মুখে পড়তে পারেন, এমন মিথ্যাও রটাচ্ছেন তিনি। তাহলে প্রকৃতই কোথায় পালিয়েছেন নিপুণ? এদিকে পালিয়ে রয়েছেন শেখ সেলিমও। তিনিও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে কি তারা দুজনই পালিয়ে একই গন্তব্যে আছেন? জনমনে এরকম রসালো কানাঘুঁষাও চলছে। ১৯৯৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের পর নিপুণ রাশিয়া চলে যান। মস্কোতে ২০০৪ পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে থাকা অবস্থাতেই বিয়ে করেন নিপুণ। যদিও সেই বিয়ে টেকেনি বেশিদিন। তবে সেই ঘরে তানিশা হোসেন নামে এক কন্যাসন্তান রয়েছে।