বাংলা সিনেমার কথা উঠলেই যে কয়েকটি বিষয় মাথায় আসে, তার প্রথমেই থাকে নায়ক-নায়িকা, সুন্দর লোকেশন, মন মাতানো গান, অ্যাকশন দৃশ্য, নায়ক-নায়িকার রোমান্স, এবং সবশেষে একটা সুন্দর সমাপ্তি। তবে এসবের মজা ফিকে হয়ে যায়, যদি চলচ্চিত্রে কোনও খলনায়কের উপস্থিতি না থাকে। খল অভিনেতা ছাড়া নায়ক নায়িকার মিলনের মজাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সব পেয়েও কিছু একটা না পাওয়ার যন্ত্রণা। ঢাকার সিনেমায় খলনায়কের ভূমিকায় এক সময় দর্শক মাতিয়েছেন গোলাম মোস্তাফা, জসীম, জাম্বু, রাজিব, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন ফরিদী, এটিএম শামসুজ্জামানদের মতো তারকা অভিনেতারা। তারা নিজেদের অভিনয় দক্ষতায় দর্শকদের মাঝে এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিলেন যে তাদের নাম শুনে দর্শকরা সিনেমা হলে যেত। নায়ক, নায়িকাদের পাশাপাশি তাদেরকে নিয়েও হতো আলোচনা-সমালোচনা। অভিনয় গুণে তারাও হয়ে ওঠেছিলেন তারকা অভিনয় শিল্পী।
জাম্বু : একসময়ে আমাদের চলচ্চিত্রে এমন কিছু চরিত্র ছিল যে চরিত্রে জাম্বুর কোন বিকল্প ছিল না। কৃষ্ণবর্ণের বিশাল শরীরের টাক মাথার এক দুর্র্ধর্ষ ভিলেন ছিলেন জাম্বু। রুদ্রমূর্তির মতো চাহনি, ঠোটের কোণে নিষ্ঠুর পৈশাচিক হাসি, কর্কট কণ্ঠস্বরের অতি ভয়ংকর চরিত্রের এক অভিনেতা। আশি-নব্বই দশকের এ্যাকশনধর্মী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা। তার অভিনয়ের নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল। অল্প সময়ের জন্য স্ক্রিনে থাকলেও, চমকে দিতে জানতেন সিনেমাদর্শকদের। পর্দায় ভিলেন জাম্বু নায়কের হাতে মার খাচ্ছে, এটা ছিল সিনেমাদর্শকদের কাছে তখনকার সময়ে বেশ মজার ও বিনোদনের বিষয়। খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। জাম্বুর উলেস্নখযোগ্য সিনেমা- এক মুঠো ভাত, সাগর ভাসা, দোস্ত দুশমন, রক্তের দাগ, ঝুমুর, অঙ্গার, শেষ পরিচয়, সাধনা, ওয়াদা, বুলবুল-এ বাগদাদ, আলিফ লায়লা আলাউদ্দিনের আশ্চার্য প্রদীপ, বন্ধু, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, অভিযান, উসিলা, নিষ্পাপ, অমর, শীষনাগ, সেলিম জাভেদ, হাসান তারেক, নির্দোষ, সাথী, পাষাণ, নাগমহল, ওমর শরীফ, লোভ লালসা, সুলতানা ডাকু, উনিশবিশ, অগ্নিপুরুষ, আঁচলবন্দি, চোর, ফেরারী, আখেরী নিশান, জিপসী সর্দার, দায়ীত্ব, রাজনন্দিনী, হিসাব চাই, প্রতিহিংসা, জনি, নেপালি মেয়ে, লটারী, নিঃস্বার্থ, ইনকিলাব, বনবাসে বেদের মেয়ে জোসনা, মর্জিনা, রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইত্যাদি। জাম্বু ২০০৪ সালের ৩ মে, ঢাকায় মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
ওয়াসিমুল বারী রাজিব : বাংলা চলচ্চিত্রে জাদরেল অভিনেতা ছিলেন রাজিব। একজন কিংবদন্তীতুল্য শক্তিমান অভিনেতা যিনি খলনায়ক হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখড়ে। এক সময় তার বলা অনেক সংলাপ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ভিলেন তথা খলচরিত্রের একজন অভিনেতা এত জনপ্রিয় হতে পারে- এ আসলে সত্যিই বিস্ময়। শুধু ভিলেন বা খলনায়ক কেনো, সব ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করার দক্ষতা বা ক্ষমতা ছিল তার। বহু ছবিতে তিনি ভালো মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সফল হয়েছেন এবং দর্শকদের প্রসংশাও পেয়েছেন। রাজিবের উলেস্নখযোগ্য সিনেমা- খোকন সোনা, পরাণ পাখি, বিদ্রোহী, মানিক রতন, মায়ের দাবী, শক্তি, ভাত দে, সম্রাট, রাজভিখারী, নকল শাহজাদা, হিসাব নিকাশ, আন্দাজ, আওয়াজ, ফুলের মালা, পদ্মগোখরা, স্ত্রী, সালমা, শক্তিশালী, জামানা, বউ শাশুড়ি, সত্যমিথ্যা, বিরাজ বউ, সন্ধান, পুষ্পমালা, জারকা, নবাব, সাহেব, খামোশ, দাগী, উসিলা, কাবিন, আয়নামতি, চাচা ভাতিজা, চন্দনা ডাকু, অবিশ্বাস, আদর্শবান, সহধর্মিণী, নিয়ত, হীরামতি, সাজানো বাগান, অবুঝ হৃদয় ইত্যাদি। এ অভিনেতা ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে, ঢাকায় মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স
হয়েছিল মাত্র ৫২ বছর।
হুমায়ুন ফরিদী : সত্তর দশকের মধ্যভাগে মঞ্চ আর টিভি নাটকের মধ্য দিয়ে অভিনয় জীবনের যাত্রা শুরু তার। পরে চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও মঞ্চে অভিনয় করে অসংখ্য ভক্তের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নেন তিনি। নায়ক কিংবা খলনায়ক- সব চরিত্রেই সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। দেশের বিনোদন জগতের শক্তিমান একজন অভিনেতা ছিলেন হুমায়ুন ফরিদী। নিজের চরিত্রকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলতেন তিনি। দর্শকরাও হারিয়ে যেতেন সেই অভিনয়ের মায়া জালে। তিনি দাপটের সঙ্গে খল চরিত্রে অভিনয় করলেও ইতিবাচক চরিত্রেও তার অভিনয় ছিল অতুলনীয়। একজন হুমায়ুন ফরিদীর মতো অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে আর হয়তো আসবে না। হুমায়ুন ফরিদীর উলস্নখযোগ্য সিনেমা- 'বিশ্বপ্রেমিক', 'অপহরণ', 'দুঃসাহস' 'দহন', 'একাত্তরের যীশু', 'দূরত্ব', 'ব্যাচেলর', 'জয়যাত্রা', 'শ্যামল ছায়া', 'মায়ের অধিকার', 'অধিকার চাই', 'ত্যাগ', 'মায়ের মর্যাদা', 'মাতৃত্ব' 'সন্ত্রাস', 'দিনমজুর', 'বীরপুরুষ' ও 'লড়াকু' ইত্যাদি। এ অভিনেতা ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজ বাড়িতে মারা যান হুমায়ূন ফরীদি। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
এটিএম শামসুজ্জামান : কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। বাংলা চলচ্চিত্রে তার অবদান রয়েছে অনেক। মৃতু্যর আগ পর্যন্ত তিনি অভিনয় করে গেছেন। অভিনয় তার রক্তে মিশে গিয়েছিলো। চলচ্চিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানের সম্পৃক্ততা ঘটে উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত 'বিশকন্যা' ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে। সেসময় চিত্রনাট্য লেখাতেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রায় শতাধিক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও কাহিনি লিখেছেন এটিএম। প্রথমদিকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করলেও ১৯৬৫ সালে ভিন্ন ধারার অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে আগমন তার। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের 'নয়নমণি' চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। সে ধারাবাহিকতায় একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এই কিংবদন্তি। পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে এটিএম শামসুজ্জামান অভিনীত উলেস্নখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- 'লাঠিয়াল', 'নয়নমণি', 'গোলাপী এখন ট্রেনে', 'অশিক্ষিত', 'সূর্যদীঘল বাড়ি', 'ছুটির ঘণ্টা', 'লাল কাজল', 'পুরস্কার', 'দায়ী কে?', 'দোলনা', 'পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'অজান্তে', 'স্বপ্নের নায়ক', 'চুড়িওয়ালা', 'শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ', 'শাস্তি', 'মোলস্না বাড়ির বউ', 'হাজার বছর ধরে', 'চাঁদের মতো বউ', 'মন বসে না পড়ার টেবিলে', 'এবাদাত', 'পরান যায় জ্বলিয়ারে', 'কুসুম কুসুম প্রেম', 'গেরিলা', 'লাল টিপ', 'চোরাবালি', 'পাংকু জামাই'। এ অভিনেতা ২০২১ সালের ২০ ফেব্রম্নয়ারি সূত্রাপুরের নিজ বাসভবনে মারা যান। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।