ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বর্তমানে তারকা শিল্পীর আকাল চলছে। এই ধারাটা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তবে হালে আগস্ট বিপস্নব হয়ে যাওয়ার পর যেন একপ্রকার মড়কই লেগেছে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি। ভালো ভালো নামকরা অভিনেতা পালিয়ে বেড়াচ্ছে রাজনৈতিক কারণে। এরা কবে সিনেমায় ফিরে আসবে জানা নেই। তবে এর প্রভাবে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে তারকার আকালে পড়েছে এতে কোনো সংশয় নেই।
ফেরদৌস আহমেদ, রিয়াজ, নিপুণ আক্তার, মিষ্টি জান্নাত, সাজু খাদেম, জায়েদ খান, মিশা সওদাগর, ডিপজলসহ আর অনেক তারকা পলাতক আছেন। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও অনেকে হতাশায় বাংলাদেশ ছেড়েছেন। নব্বই দশক ছিল ছোটপর্দার সোনালি যুগ। চ্যানেল ছিল একমাত্র বিটিভি। এই চ্যানেল ঘিরেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে শতাধিক তারকার। যেমন ব্যস্ত ছিলেন আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, তারিক আনাম খান, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, তৌকীর আহমেদ, তমালিকা কর্মকার. বিজরি বরকতউলস্ন্যাহ, আজিজুল হাকিমরা। তেমনি ব্যস্ত ছিলেন সেই সময়ের নতুন লিটু আনাম, টনি ডায়েস, দীপা খন্দকার, তারিন, সুইটি, মাহফুজ আহমেদের মতো তারকারা।
কিন্তু বর্তমানে হতাশা আর অভিমানে দেশ ছাড়ছেন। চেষ্টা করছেন বিদেশে স্থায়ী হতে। কয়েক বছরের সেই দৃশ্যটা চলতি বছর বেড়েছে। তারকাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাতেই চোখ বেশি তারকাদের।
এসব তারকার মধ্যে রয়েছেন মোনালিসা, মিলা হোসাইন, তিন্নি, শিরীন বকুল, রোমানা, শায়না আমিন, আমব্রিন, নাফিজা জাহান, ঈশিকা খান, রিচি সোলাইমানদের নাম। এদের মধ্যে মোনালিসা, মিলা, রিচি, ঈশিকা মাঝে মধ্যেই দেশে আসেন।
মোটকথা, ছোটপর্দা আর বড়পর্দা মিলিয়ে এখন তারকার আকালে ভুগছে। যেগুলো কাজ করছে সেগুলোর বেশির ভাগই 'টোকাই অভিনেতা-অভিনেত্রী' দেখা যায়। এগুলোর দর্শক আছে, তবে তাতে কারা পারফর্ম করছে সেসব নামধাম পরিচয়ের নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না দর্শক।
শোনা যাচ্ছে, শোবিজের একাধিক তারকা বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। এখানে পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, অমিত হাসান, ওমর সানী-মৌসুমী দম্পতি, মিশা সওদাগর, বাপ্পী চৌধুরীর মতো তারকারাও রয়েছেন। নিজের ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা। এই তারকাদের তালিকায় আছেন অনেক নাটক-চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক-গীতিকারসহ সংগীতাঙ্গনেরও অনেক তারকা।
আবার বড়পর্দার সিনেমারও কোনো ব্যবসা নেই। এই সত্যটি এখন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে এক শাকিব খান ছাড়া বাকি সব নায়কের ক্ষেত্রেই খাটে।
একটি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়েই থাকে তারকা অভিনয় শিল্পীর ওপর। বিশ্বের যে কোনো ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেই এটা খাটে। অনেকেই বলেন, আজকে ঢাকাই সিনেমার বাজার পড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ এই তারকা শিল্পীর অভাব। অথচ এই ইন্ডাস্ট্রিতে সেই ষাট দশক থেকে শুরু করে নব্বই পর্যন্ত ঝাঁকেঝাঁকে সুপারস্টার, মেগাস্টার ছিলেন।
সেই উত্তম কুমার খ্যাত রহমান, দিলীপ কুমার খ্যাত নাদিম, আজিম, হাসান ইমাম, নায়করাজ রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, ওয়াসিম, ফারুক, আলমগীর, মেগাস্টার খ্যাত উজ্জ্বল, জাভেদ, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাহমুদ কলি, বাপ্পা রাজ, রুবেল, সুজাতা, সুলতানা জামান, শবনম, সুমিতা দেবী, সুচন্দা, রোজী আফসারী, নাসিমা খান, শাবানা, কবরী, ববিতা, জয়শ্রী, চম্পা, সুচরিতা, নূতন, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, দিতি, অরুণা বিশ্বাস, দোয়েল, শাবনূর, শাবনাজ, মৌসুমী, পপি, শিমলা, নিপুণ, পূর্ণিমা, মান্না, সালমান শাহ, নাঈম, সোহেল চৌধুরী, রিয়াজ, ফেরদৌসসহ অনেকে মিলে যে তারার মেলা বসত সেই চিরচেনা রূপটি কবেই কালের অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে!
নায়কদের বিপরীতে যারা খলনায়ক ছিলেন তারাও একেকজন সময়ের সেরা 'খল সুপারস্টার'। এদের মধ্যে আছেন গোলাম মুস্তাফা, খলিল, এটিএম শামসুজ্জামান, রাজিব, মিজু আহমেদ, আহমদ শরীফ, সাদেক বাচ্চু, হুমায়ুন ফরীদি প্রমুখ। এখন তো সেই খল অভিনেতাই নেই সেখানে একজন নায়ক কী করে সুপারস্টার হয়ে উঠবেন?
চিত্র নায়িকা রোজিনা তাই বলেন, 'এখন দু'চার জন নায়ক থাকলেও তাদেরকে সাপোর্ট দিবে সেরকম তো একজন নায়িকাও খুঁজে পাই না। এখন তো কোনো নায়িকাই নেই যাদের দিয়ে নায়করা জ্বলেন উঠবেন। সুপারস্টার হয়ে উঠবেন। অথচ আমাদের সময়ের নায়িকাদের দেখেন তারা কেউই কারো চেয়ে কম যান না। এখন সেরকম নায়িকা কোথায় পাবেন?'
চিত্রনায়িকা রোজিনার এই পর্যবেক্ষণটিও গুরুত্বপূর্ণ। একসময়ে যারা সুপারস্টার ছিলেন তাদের জুটিগুলোতেই পরিষ্কার কেন তারা সুপারস্টার। সুজাতা-আজিম, হাসান ইমাম-সুলতানা জামান, রহমান-শবনম, রাজ্জাক-কবরী, ফারুক-কবরী, আলমগীর-শাবানা, বুলবুল আহমেদ-জয়শ্রী, জাফর ইকবাল-ববিতা, ওয়াসিম-রোজিনা, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি, বাপ্পা-অরুণা, সালমান শাহ-মৌসুমী, রুবেল-পপি, মান্না-নিপুণ, রিয়াজ-শাবনূর, ফেরদৌস-পূর্ণিমা প্রভৃতি। এদের প্রত্যেকেরই আবার একাধিক নায়ক-নায়িকার সঙ্গে জুটি হয়েছে। খ্যাতিও পেয়েছে সবগুলোই। নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে তো শবনম, শাবানা থেকে শুরু করে চিত্রনায়িকা নূতন পর্যন্ত জুটি হয়েছে এবং প্রতিটি জুটিই সফল হয়েছে। আলমগীর, ওয়াসিম, ফারুক, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চনেরও বিভিন্ন নায়িকার সঙ্গে জুটি হয়েছে।
বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ক-নায়িকা নেই এমন নয়। এরপরও প্রচুর নায়ক-নায়িকা এসেছেন। কিন্তু কেউই তারকা ইমেজের মধ্যে পড়েন না। ফলে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির খালি মাঠে একাই ছড়ি ঘোরাচ্ছেন শাকিব খান। তার ছবিই একচেটিয়া ব্যবসা করছে। অন্যগুলো যদি ব্যবসা করে তো সেটা গল্পের জোরেই, নায়ক-নায়িকার জোরে নয়। সেজন্য শাকিব খালি মাঠের তারকা বলে অনেকে তাকে 'সুপার স্টার' মানতেও নারাজ। সুপারস্টারের জন্য প্রথম যে গুণটি থাকা দরকার সোসাইটিতে সেই 'ব্যক্তিত্ব' বা 'পার্সোনালিটি'র ইমেজ বা ভাবমূর্তিটিই গড়ে ওঠেনি শাকিব খানের। যিনি 'সুপারস্টার' তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজ, জনতামন্ডলী, নারীমহল সর্বত্রই এমন ভাবমূর্তির অধিকারী হবেন- সবাই তাকে দেখামাত্র সমীহ করবে। সবাইর চোখেই একটা সম্ভ্রমের দু্যতি দেখা দিবে। যা শাকিব খানের ক্ষেত্রে একদমই দেখা যায় না। তাই তাকে অনেকে 'ছ্যাবলা'ও বলে থাকেন। ভক্তরাও যেন সেরকমই 'ছ্যাবলা' টাইপের যারা তার 'পদচুম্বন' করেন। অতিরিক্ত আদিখ্যেতা দেখান। কিন্তু তাতে একদমই সমীহভাব নেই। এ কারণেই অনেকে তাকে 'সো কল্ড' বা 'তথাকথিত সুপারস্টার'ও বলেন। এ অবস্থায় ইন্ডাস্ট্রিতে যদি নতুন তারকারই জন্ম না হয় ভবিষ্যতের ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি কীসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে?