পুরুষতান্ত্রিক ইন্ডাস্ট্রিতে নারীপ্রধান সিনেমা

প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
'ন ডরাই' সিনেমার একটি দৃশ্যে সুনেরাহ বিনতে কামাল
ষাট দশকের শুরু থেকেই সিনেমাকে একমাত্র বিনোদনের উপকরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর এই সিনেমার নিরান্নব্বই শতাংশই পুরুষপ্রধান বা নায়কপ্রধান সিনেমা। ঢাকাই সিনেমায় তো বটেই; বিশ্ব সিনেমাতেও নারীপ্রধান সিনেমা একেবারেই হাতে গোনা। আবার যেসব নারীপ্রধান সিনেমা হয়েছে সেখানেও বিনোদনটাকেই প্রধান হিসেবে আনা হয়েছে। নারীর একান্ত বাস্তবচিত্র খুব কমই প্রতিফলিত হয়েছে সেসব নারীপ্রধান সিনেমায়। তারপরও এমন নারীপ্রধান সিনেমাও খুব বেশি হয়নি। শুধু ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতেই নয়, পৃথিবীর সব ইন্ডাস্ট্রিতেই। কমিউনিজমশাসিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে এর মোটামুটি ব্যতিক্রম দেখা গেছে। ম্যাক্‌সিম গোর্কির 'মা' অবলম্বনসহ অনেক নারীপ্রধান সিনেমা দেখা গেছে চমৎকার সব আখ্যান নিয়ে নির্মিত হয়েছে সেসব সিনেমা। তবে নারী শিল্পীদের এই ব্যতিক্রম দিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট থাকা যায়? তাই বলিউড অভিনেত্রী কারিনা কাপুর বলেছেন, ১৭-১৮ বছর বয়সে প্রায় প্রত্যেকের স্বপ্ন থাকে একজন বড় অভিনেত্রী হওয়ার। কিন্তু বাস্তবে পুরুষতান্ত্রিক ইন্ডাস্ট্রিতে একজন অভিনেত্রীকে টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন। সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সাক্ষাৎকারে পুরুষশাসিত ইন্ডাস্ট্রিতে একজন অভিনেত্রীর কী ধরনের চ্যালেঞ্জ, সে বিষয়ে কথা বলেন কারিনা কাপুর। তিনি বলেন, বলিউডে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা থেকে টিকিয়ে রাখা আরও কঠিন। পুরুষতান্ত্রিক ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সব সময় নতুনত্ব কিছু নিয়ে আসতে হয়। আমি ছাড়াও এমন অনেক অভিনেত্রী রয়েছেন, যারা বছরের পর বছর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। তবে এর জন্য প্রতি পাঁচ বছরে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয় আমি নতুন কি দিতে পারলাম ইন্ডাস্ট্রিকে? কারিনা বলেন, নিজেকে টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন। তাই আমি বেছে বেছে কাজ করি। সেটি বাকিংহাম মার্ডারস, সিংগাম, ক্রু বা জানে জান- এগুলো সব স্ট্রিমিং পস্ন্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে। আমি মনে করি, এটি বড় পর্দাতেও দুর্দান্ত হিট করত। বলিউড বা টালিউডের তুলনায় ঢাকাই সিনেমার বয়স বর্তমানে যেখানে এসে পৌঁছেছে সেটাও কিন্তু কম নয়। প্রথম সিনেমা 'মুখ ও মুখোশ' মুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সত্তর বছর চলছে ঢাকাই সিনেমার বয়স। স্বাধীনতার আগে যদিও ঢাকাই বাংলা সিনেমাকে উর্দু সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো; কিন্তু স্বাধীনতার পর একেবারেই একচেটিয়া হয়ে পড়ে ঢাকাই বাংলা সিনেমা। কিন্তু এসব সিনেমায় বাংলার 'নারী সমাজ' নিয়ে তার বাস্তবচিত্র বলার মতো কতটা প্রতিফলিত হয়েছে? যারা নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন তাদের অনেকেই কারিনা কাপুরের মতো এ নিয়ে আক্ষেপ করেন যে তারা নারীপ্রধান গল্পের সিনেমায় অভিনয় করতে পারছেন না। যে কারণে তারা তাদের অভিনয়কে প্রমাণ করার সুযোগও পাচ্ছেন কম। পুরো সিনেমাটির গল্পজুড়েই থাকে শুধু নায়ক আর খল-অভিনেতা। অর্থাৎ গোটা ঢাকাই সিনেমা রয়ে গেছে নায়ক. খল-অভিনেতা বা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকাই সিনেমার এমন বাস্তবতায় তখন নারীপ্রধান সিনেমা কী করে হবে? নারীর জীবন যে কীরকম সংগ্রামময় এটা দেশের তেমন কোনো সিনেমায় প্রতিফলিত না হলেও কোনো কোনো চলচ্চিত্র পরিচালকের সিনেমায় নারীর সংগ্রামময় জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। মসিহউদ্দিন শাকের এবং শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত 'সূর্য দীঘল বাড়ী' সিনেমা তার একটি উদাহরণ। বরেণ্য উপন্যাসিক আবু ইসহাক রচিত 'সূর্য দীঘল বাড়ী' অবলম্বনে তৈরি এ সিনেমাটি সরকারি অনুদানের প্রথম সিনেমা। অনুদানের হিসেবে এই সিনেমাটিই ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে এ কারণে, সিনেমাটিতে প্রথম নারীপ্রধান হিসেবে নারীর বাস্তবচিত্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে। বাংলা ১৩৫০ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অবিভক্ত ভারতের বাংলায় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে 'পঞ্চাশের আকাল' নামে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ প্রাণ হারায়। যারা কোনোমতে শহরের লঙ্গরখানায় পাত পেতে বাঁচতে পেরেছিল তাদেরই একজন একালের স্বামী পরিত্যক্ত জয়গুন। সঙ্গে তার মৃত প্রথম স্বামীর ঘরের ছেলে ও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের মেয়ে। আরও আছে মৃত ভাইয়ের স্ত্রী-পুত্র। তারা গ্রামে ফিরে এসে এমন এক খন্ড জমিতে ঘর তৈরি করে যেটি অপয়া ভিটে বলে পরিচিতি ছিল। জীবনযুদ্ধে যখন সে প্রাণপণ লড়ছে তখন তার প্রতি গায়ের মোড়লের দৃষ্টি পড়ে। দ্বিতীয় স্বামীও তাকে আবার ঘরে তুলতে চায়। সে কারো প্রস্তাবেই সায় দেয় না। কিন্তু এ দুজনের সাক্ষাৎ ঘটে এবং মোড়ল তার প্রতিযোগীকে হত্যা করে। ঘটনার একমাত্র দর্শক হিসেবে জয়গুনকেও মূল্য দিতে হয় অন্যভাবে। চলচ্চিত্রটিতে একজন নারী তার চারপাশের বৈরী পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে কী করে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে তারই বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে এই নারীপ্রধান সিনেমাটিতে। তবে যেহেতু এই সিনেমাটিতে প্রচলিত বিনোদনকে উপেক্ষা করা হয়েছে, সে কারণে নিটোল বিনোদনপ্রিয় দর্শকও এ সিনেমাটিকে উপেক্ষা করে। আবার এমন সিনেমাও আছে যে সিনেমা নারীপ্রধান হলেও বাস্তবতাবর্জিত বিনোদনমূলক আখ্যাননির্ভর। বাঙালি দর্শক অবশ্য এমন বিনোদনমূলক নারীপ্রধান সিনেমা দেখতে চায়। যেমন ঢাকায় নির্মিত প্রথম নারীকেন্দ্রিক সিনেমা 'রূপবান'। সালাউদ্দিন নির্মিত এই ছবির নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুজাতা। নারীর ত্যাগ-তিতিক্ষা মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে এই সিনেমাটিতে। লোককাহিনিনির্ভর ছবিটিতে অভিনয়ে আরও যারা ছিলেন তারা হলেন- আনোয়ার হোসেন, ইনাম আহমেদ, মনসুর, চন্দনা, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি ওই সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সত্য সাহার সঙ্গীত পরিচালনায় করা এই ছবির গানগুলো দীর্ঘদিন দেশের মানুষের মুখে মুখে ছিল। শহিদুলস্নাহ কায়সার রচিত 'সারেং বৌ' সিনেমাটি যেমন দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল, তেমন তার গানও মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছিল। সিনেমাটির বিখ্যাত গান- 'ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া'- গানটি শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না দেশে। ছবিটির প্রধান চরিত্র সারেংয়ের বৌ হিসেবে এই নারী চরিত্রটির জন্যই এমন একটি অবিস্মরণীয় গানের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আবদুলস্নাহ আল মামুন। এতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন ফারুক ও কবরী। ছবিতে 'নবিতন' নামের এক গৃহবধূর ভূমিকায় দেখা যায় কবরীকে; যে তার স্বামী, সংসার ও নিজের প্রতি সৎ ও নিষ্ঠাবান থাকার জন্য নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে নেয় তার জীবনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে নারীপ্রধান চরিত্রের সিনেমা নির্মাণে যিনি অন্য সবাইর চেয়ে এগিয়ে থাকবেন তিনি কিংবদন্তি পরিচালক আমজাদ হোসেন। নারীর জীবনযুদ্ধ নিয়ে তিনি একাধিক সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য 'গোলাপী এখন ট্রেনে' ও 'ভাত দে' অন্যতম। 'গোলাপী এখন ট্রেনে' মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। ছবিতে অভিনয় করেছেন ববিতা, ফারুক, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, আনোয়ারা, রওশন জামিল, এটিএম শামসুজ্জামানের মতো নন্দিত তারকারা। ছবিটি মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছিল। তৎকালীন সমাজের বাস্তবতায় একজন খেটে খাওয়া নারীর অসামান্য সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ১১টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল এই ছবি। অনেকের মতে, এটিই ববিতার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সিনেমা। এছাড়া চিত্রনায়িকা শাবানা প্রযোজিত 'ভাত দে' সিনেমাটিও আমজাদ হোসেনের আরও এক কালজয়ী নির্মাণ। পাশাপাশি এই সিনেমাটির মধ্য দিয়ে শাবানা তার ক্যারিয়ারকেও এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। ছবিটিতে পাওয়া গেছে শাবানার অভিনয় দক্ষতার সর্বোৎকৃষ্ট পরিচয়। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর এই ছবি ৯টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল। ছবিতে এক গরিব গায়েনের মেয়ে জরির ভূমিকায় অভিনয় করেন শাবানা। একদিন ভাতের তীব্র অনটনে পড়ে বাইরে বের হতে গিয়ে মারা যায় জরির বাবা। সেই থেকে জরির অভাব-অনটনের মাত্রা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। প্রেম ও করুণ পরিণতি তাকে ঠেলে দেয় চরম দুরবস্থায়। ভাতের জন্য জরির অবর্ণনীয় কষ্ট আর করুণ পরিণতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে। অনেকে মনে করেন সিনেমাটির রূপকল্প নেওয়া হয়েছে কবি রফিক আজাদ লিখিত 'ভাত দে হারামজাদা' নামের বিখ্যাত কবিতা থেকে। ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য শাবানা পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।