জসীমের চলে যাওয়ার ২৬ বছর

জসীমের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ড্রিমগার্লখ্যাত নায়িকা সুচরিতা। পরে তিনি ঢাকার প্রথম সবাক সিনেমার নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেন

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
ঢাকাই সিনেমায় জসীমের আবির্ভাব হয়েছিল খলনায়ক হিসেবে। সে সময় খলনায়ক হিসেবে বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। দর্শক মহলে বেশ পরিচিতিও পেয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পরে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কদের একজন হিসেবে। বিশেষ করে অ্যাকশন নায়ক হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে আজও তিনি কিংবদন্তি হয়ে আছেন। অনেকেই তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের অ্যাকশনের পথপ্রদর্শক হিসেবে মনে করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে চিরবিদায় নেন চিত্রনায়ক জসীম। অল্পদিনের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রিয় নায়ক হন তিনি। তিনিই একমাত্র নায়ক, যিনি একাধারে ধুন্ধুমার অ্যাকশন দৃশ্য করে হাততালি কুড়িয়ে নিতেন আবার নায়ক হয়ে দর্শকদের আবেগে জড়াতেন, নীরবে অশ্রম্নবিয়োগের জন্য তার অভিনয় দাগ কাটে ঢাকাই ছবির দর্শকের মনে। ৮ অক্টোবর চিত্রনায়ক জসীমের মৃতু্যর ২৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, ততদিন এই বাংলার মানুষ চিত্রনায়ক জসীমকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তাকে ভুলে যাওয়া কঠিন। নায়ক জসীমের জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯৫০ সাল। ঢাকার কেরানীগঞ্জের বক্সনগর গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। জসীমের আসল নাম আবদুল খায়ের জসীম উদ্দিন। চিত্রনায়ক পরিচয়ের আগে জসীম একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। দুই নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। বরেণ্য অভিনেতা আজিমের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন যুদ্ধফেরত জসীম। ১৯৭২ সালে 'দেবর' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তার। এরপর ১৯৭৩ সালে দেওয়ান নজরুল পরিচালিত 'দোস্ত দুশমন' সিনেমা দিয়ে আলোচনায় আসেন জসীম। এটি ছিল কালজয়ী হিন্দি সিনেমা 'শোলে'-এর রিমেক। এতে জসীম অভিনয় করেন গাব্বার সিং-এর খলনায়ক চরিত্রে। সিনেমাটি দারুণ সফলতা পেয়েছিল। সেই সুবাদে জসীম বেশ কয়েক বছর খলনায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তার সঙ্গে কাজ করেন। এই ছবিতে খল-অভিনেতা হিসেবে এত ভালো করেছিলেন যে তখন 'শোলে' সিনেমার খলচরিত্রে পারফর্ম করা 'গব্বর সিংহ' আমজাদ খানও জসীমের দারুণ প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, 'জসীম তো আমার চেয়েও অনেক সুন্দর অভিনয় করেছে।' আমজাদ খান 'দুস্ত দুশমন' ছবিটি হলে গিয়ে দেখেছিলেন। নায়ক হিসেবে জসীম আত্মপ্রকাশ করেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর পরিচালনায় 'সবুজ সাথী' সিনেমায়। এরপর টানা কাজ করে গেছেন নায়ক হিসেবে। আশির দশকে জসীম ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। প্রায় সব নায়িকার সঙ্গে জুটি বাঁধলেও শাবানা ও রোজিনার সঙ্গে জসীমের জুটিবদ্ধ সিনেমাগুলো বেশি সাফল্য পেয়েছিল। শাবানার বিপরীতে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার গল্পটা কেমন ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু গণমাধ্যমকে বলেন, ''একবার জসীমের বাসায় বসে আছি। জসীম বললেন, 'ঝন্টু ভাই আমি এক্সট্রা শিল্পী হিসেবে অভিনয় করছি। আমাকে একজন বড় পরিচালক বলেছেন, কালকে বিকালে আপনার শুটিং আছে। তিনি এফডিসিতে যেতে বলেছেন। আমি জানতে চাইলাম, আমার শট কী? তিনি জানালেন, সিনেমার নায়িকা শাবানাকে তোমার কাঁধে তুলে বসের (মেইন ভিলেন) সামনে রাখতে হবে। এটাই তোমার শট। এত বড় নায়িকাকে কাঁধে তুলব! এটা আমার জন্য বিরাট বিষয়! পরদিন সকালে বাজারে গিয়ে তিনটি লাক্স সাবান কিনেছি। শেভ করে ভালো করে গোসল করেছি। দুপুরে আবার গোসল করেছি। যাতে করে আমার শরীর থেকে কোনো গন্ধটন্ধ না বের হয়।" শুনে আমি বললাম, 'আপনাকে আমি একটা সারপ্রাইজ দেব! পরশু দিন নতুন একটা সিনেমায় আপনাকে নিচ্ছি। আলমগীর, সুচরিতা, শাবানা এবং আপনি আছেন। চলে আসবেন।' এরপর জসীম শুটিংয়ে এলেন। ড্রেস পরে রেডি হয়ে সে বসে আছে। শাবানা ম্যাডামকে বললাম, 'আপনার ডায়ালগ- আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তুমি আমার প্রথম প্রেম।' তিনি বললেন, 'এটা ব্যাপার না। ক্যামেরা রেডি করেন। আমি ডায়ালগ দিচ্ছি। আলমগীরকে ডাকেন।' আমি তখন জসীমকে সামনে দাঁড় করিয়ে বললাম, 'ম্যাডাম শট দেন।' প্রথমে শাবানা ম্যাডাম ঠিক বুঝতে পারেননি। আমার দিকে তাকালেন। আমি শাবানা ম্যাডামকে একটু পাশে নিয়ে গিয়ে বললাম, ''ম্যাডাম, আমি আলমগীরের সঙ্গে আপনাকে রাখিনি, জসীমের সঙ্গে রেখেছি। কিন্তু বিষয়টি আপনাকে বলিনি। এটা আমার ঠিক হয়নি। আপনি যদি বলেন, আমি 'সরি' বলবো।' তখন শাবানা ম্যাডাম বললেন, 'না সরি বলার দরকার নেই চলেন!'' এদিকে শাবানার সামনে দাঁড়িয়ে জসীমও হতবাক! কারণ জসীম কিছুই জানেন না। এরপর শাবানা জসীমের হাত ধরে বললেন, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি।' জসীম সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'এই ক্যামেরা কাট কাট! এটা ভুল হচ্ছে!' আমার কাছে এসে জসীম বললেন, 'ম্যাডাম আমারে কী কইতাছে?' আমি বললাম, 'চুপ থাকেন ওখানে যান।' আমাকে টান দিয়ে ফ্লোরের বাইরে নিয়ে বললেন, 'ভুল হইতাছে না তো!' আমি বললাম, 'আরে না, ভুল হচ্ছে না। এটাই। আমি তার সঙ্গে আপনাকে রেখেছি।' শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। এ সিনেমা মুক্তির পর দারুণ হিট হয়েছিল।'' দেলোয়ার জাহান ঝন্টু জসিমকে 'ওমর শরীফ' সিনেমায় প্রথম নায়ক হিসেবে কাস্ট করেন। তারপর জসীমকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক দর্শকপ্রিয় সিনেমা উপহার দেন এই নায়ক। জসিম অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন 'রংবাজ', 'তুফান', 'জবাব', 'নাগ নাগিনী', 'বদলা', 'বারুদ', 'সুন্দরী', 'কসাই', 'লালু মাস্তান', 'নবাবজাদা', 'অভিযান', 'কালিয়া', 'বাংলার নায়ক', 'গরিবের ওস্তাদ', 'ভাইবোন', 'মেয়েরাও মানুষ', 'পরিবার', 'রাজা বাবু', 'বুকের ধন', 'স্বামী কেন আসামি', 'লাল গোলাপ', 'দাগী', 'টাইগার', 'হাবিলদার', 'ভালোবাসার ঘর' প্রভৃতি সুপারহিট সিনেমায়। সব মিলিয়ে প্রায় দুইশ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। নায়ক জসীমই আবিষ্কার করেছিলেন আজকের নায়ক রিয়াজকে। ১৯৯৪ সালে রিয়াজ চাচাতো বোন ববিতার সঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) ঘুরতে এসে জসীমের নজরে পড়েন। জসীম তখন তাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে জসীমের সঙ্গে 'বাংলার নায়ক' নামের একটি সিনেমায় ১৯৯৫ সালে অভিনয় করেন রিয়াজ। এই কালজয়ী নায়ক ও প্রযোজকের মৃতু্যর পর তাকে সম্মান জানাতে এবং আজীবন স্মরণ রাখতে এফডিসির সর্ববৃহৎ ২ নম্বর ফ্লোরকে জসীম ফ্লোর নামকরণ করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের কোনো স্বীকৃতি না পেলেও জসীম এখনো অম্স্নান দর্শকদের মনে। বাংলা সিনেমার দর্শকরা এখনো তাকে ভালোবাসে, মন থেকে শ্রদ্ধা করে। জসীমের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ড্রিমগার্লখ্যাত নায়িকা সুচরিতা। পরে তিনি ঢাকার প্রথম সবাক সিনেমার নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তার মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেন। দুই যুগ ধরে বাবার স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন জসীমের তিন ছেলে- এ কে রাহুল, এ কে রাতুল ও এ কে সামী। বাবার পথ ধরে অভিনয়ে নাম লেখাননি তারা, কাজ করছেন সঙ্গীতজগতে। তিনজনই যুক্ত ব্যান্ডের সঙ্গে। এর মধ্যে রাহুল 'ট্রেনরেক' ব্যান্ডের গিটারিস্ট ও 'পরাহো' ব্যান্ডের ড্রামার, রাতুল ও সামী যুক্ত আছেন 'ওইনড' ব্যান্ডের সঙ্গে। রাতুল ওইনডের ভোকালিস্ট ও বেজিস্ট, সামী ড্রামার।