স্বৈরাচার পতিত সরকারের গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে যত অনিয়ম ছিল, এর সব কয়টিতে পর্যায়ক্রমে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সেন্সর বোর্ড যুগের অবসান ঘটল। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো 'বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড' গঠন করেছে সরকার।
গত রোববার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। 'বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩'-এর ৩ ধারার উপধারা (১) অনুযায়ী ১৫ সদস্যের সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৭ সেপ্টেম্বর সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করে সরকার। তবে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন না করে ১৯৬৩ সালের 'সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট'-এ 'সেন্সর বোর্ড' পুনর্গঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন নির্মাতা, চলচ্চিত্র সংগঠকরা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে সার্টিফিকেশন বোর্ড করেছে সরকার। সার্টিফিকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিব ও সদস্যসচিবের দায়িত্ব পাচ্ছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান। পদাধিকারবলে সদস্য হিসেবে থাকছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি। এর বাইরে সদস্যদের তালিকায় রয়েছেন- ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গবেষক জাকির হোসেন রাজু, নির্মাতা রফিকুল আনোয়ার রাসেল, চলচ্চিত্র প্রযোজক জাহিদ হোসেন, চলচ্চিত্র সম্পাদক ইকবাল এহসানুল কবির, কাজী নওশাবা আহমেদ, নির্মাতা খিজির হায়াত খান ও নির্মাতা তাসমিয়া আফরিন মৌ।
সদস্যের তালিকায় আরও রয়েছেন- আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র), জননিরাপত্তা বিভাগের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সেন্সর বোর্ডের ১৫ জনের মধ্যে ১৩ জন সার্টিফিকেশন বোর্ডে রয়েছেন। সেন্সর বোর্ডের সদস্যপদ ফিরিয়ে দেন আশফাক নিপুন, তিনি সার্টিফিকেশন বোর্ডে নেই। সেন্সর বোর্ডের আরেক সদস্য লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনও সার্টিফিকেশন বোর্ডে নেই। তাদের বদলে চলচ্চিত্র প্রযোজক জাহিদ হোসেন, চলচ্চিত্র সম্পাদক ইকবাল এহসানুল কবিরকে যুক্ত করা হয়েছে। তবে প্রযোজক জাহিদ হোসেনকে সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য করায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। চলচ্চিত্রের সংশ্লিষ্টরা অনেকেই দাবি করেছেন, জাহিদ হোসেন চলচ্চিত্র লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন তিনি। এমন ব্যক্তি কী করে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের মতো জায়গায় ঠাঁই পেতে পারেন, এ নিয়ে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
এদিকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২৩'র জুরি বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (চলচ্চিত্র) সভাপতি করে মোট ১৩ জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হয়েছে এই জুরি বোর্ড। রোববার ১৫ সেপ্টেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে সভাপতি হিসেবে আছেন- অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র), তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং সদস্যসচিব হিসেবে আছেন- সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান। বরাবরের মতোই মোট ২৮টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া হবে বলেও উলেস্নখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। জুরি বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন- সঙ্গীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ, অভিনেত্রী অপি করিম, অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন, চিত্রগ্রাহক বরকত হোসেন, গায়িকা নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি। এ ছাড়াও সদস্য হিসেবে জুরি বোর্ডে আরও রয়েছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি এসএম ইমরান হোসেন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাংবাদিক ওয়াহিদ সুজন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে পুনর্গঠিত জুরি বোর্ডের কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র পর্যবেক্ষণপূর্বক পুরস্কারের জন্য চলচ্চিত্র, শিল্পী ও কলাকুশলীদের নাম সুপারিশ করবে নতুন এই জুরি বোর্ড।
তবে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন শেষ পর্যন্ত জুরি বোর্ড থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ খবর তিনি নিজেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
পরিবর্তন এসেছে টিভি নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন শিল্পী সংঘের কমিটিতেও। বর্তমান কমিটিকে 'নিষ্ক্রিয়' করে সংগঠনে সংস্কার চালানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; যেজন্য অভিনেতা তারিক আনাম খানের ওপর ভরসা রেখেছেন শিল্পীরা। সংস্কারকামী শিল্পীদের তোলা সংস্কারের দাবিতে মেয়াদ শেষ হওয়ার সাড়ে পাঁচ মাস আগেই নিষ্ক্রিয় করা হলো এই টেলিভিশন নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন অভিনয়শিল্পী সংঘ।
২১ সেপ্টেম্বর মহাখালীর সেনা গৌরব মিলনায়তনে অভিনয়শিল্পী সংঘের বিশেষ সাধারণ সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন- সংঘের সদস্য শিল্পীরা। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, তাদের হয়ে কাজ করাসহ নানা অভিযোগ ও দাবির মুখে বিশেষ সভা আহ্বান করেছিল সংগঠনটি।
সংস্কারের মাধ্যমে সংগঠনের নতুন নির্বাচন করা এবং বর্তমান কমিটিকে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখতে এই 'অন্তর্র্বর্তীকালীন সংস্কার কমিটি' কাজ করবে বলে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এদিকে সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন ও নতুন কমিটির হাতে সংগঠনকে তুলে দিতে একজন জ্যেষ্ঠ অভিনেতাকে অন্তর্বর্তী প্রধান করা হয়েছে। বিকাল ৫টায় শুরু হয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে চলে শিল্পী সংঘের সভা। সেখানে চলমান কমিটিকে নিষ্ক্রিয় ঘোষণা করে নতুন অন্তর্বর্তী কমিটির প্রস্তাব দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম অন্তর্বর্তী কমিটির প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করেন জ্যেষ্ঠ অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাম। সিদ্ধান্ত হয়, তারিক আনাম খান কমিটির বাকি সদস্যদের বেছে নেবেন। তার নেতৃত্বে আগামী চার মাসের মধ্যে নতুন কমিটি সংগঠনের সংস্কার শেষে নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের
আয়োজন করবেন।
জানা গেছে, পুরনো কমিটি থেকে চারজন ও সংস্কারপ্রত্যাশী শিল্পীদের মধ্যে থেকে চারজনকে নিয়ে শিগগিরই অন্তর্বর্তী কমিটি গঠিত হবে। পুরনো কমিটি নতুন অন্তর্বর্তী কমিটিকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে, তবে তাদের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তবে সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম ও সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান নির্বাহী কমিটির দায়িত্বগুলো পালন করে যাবেন। এসব প্রস্তাব সমর্থন করেছেন সাধারণ সদস্যরা।
এই নতুন করে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও অন্যান্য সংস্থা। জাতীয় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতি, প্রযোজক সমিতি প্রভৃতি।